জানা নেই!

[ছবিটি লেখকের হাতে আঁকা, প্রায় এক দশক আগের]

শিরোনামটা “এলোমেলো শৈশব” দিবার একমাত্র কারণ, ঘটনাগুলোর সময়রেখা কোন নির্ধারিত ছকে বাঁধা নয়। ছোটবেলার যখন যে বিষয়টা মাথায় আসছে, সেটাই লিখে ফেলছি। ব্লগে লিখে রাখছি খুব বড় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। একান্তই নিজের জন্য! অনেক বয়স যখন হয়ে যাবে, বুড়িয়ে যাব যখন, তখন যদি নিজে পড়তে নাও পারি, নাতি-নাতনিদের অনুরোধ করব পড়ে শোনাবার জন্য। আর পাবলিকলি রাখা হচ্ছে এজন্য যে, কাছের মানুষগুলোর মন্তব্য-ভৎর্সনা থেকে তারা ধারণা পাবেন, আমার আশেপাশে কত রসিক বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন।

এই সিরিজ শুরু করা হয় ২০১৭ সালে। এটার একটা আগের পর্ব আছে। আগ্রহী পাঠক চাইলে পড়তে পারেন – এলোমেলো শৈশব – ২

আমার শৈশব গণতন্ত্র চর্চাঃ

আগের পর্বে আমার স্কুলের কথা এসেছে। স্কুলটা একটু যে ভিন্ন তা বলার অবকাশ রাখে না। অবশ্য আমার কথাবার্তায় এই বিশেষ স্কুলটি খানিকটা বেশি পরিমাণ বিশেষণে অলংকৃত হয়ে আসতেই পারে। এর দুটি কারণ। একটি কারণ চিরায়ত। সেটা হল, আমি এই স্কুলের ছাত্র। আরেকটি কারণ শাশ্বত সনাতন! এই স্কুলের অধ্যক্ষ স্বয়ং আমার বাবা! এবং এই স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমার মা-ও একজন সহকারি শিক্ষক হিসেবে আছেন! এবং এজন্যই একজন লেখক হিসেবে যে মধ্যপন্থা বা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবার কথা, সেটি বেমালুম ভুলে যাবার বিষয়টি এ লেখায় সচেতনভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে! প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এ পর্বটি অনেকটা আমার বিজয়গাঁথার কীর্তন গাইবার মত। তাই আমাকে যারা বিশেষ একটা পছন্দ করেন না এ অংশটুকু বাদ দিয়ে যেতে পারেন।

আমি এই স্কুলে পড়াকালীন, ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত ‘নির্বাচিত’ ক্যাপ্টেন এবং ক্লাস ফাইভে একই উপায়ে ভিপি পদে বহাল ছিলাম! এর শুরুটা একটু মজার। স্কুলটার কাঠামোটা তখনকার দিনে ছিল কাঁচাপাকা। যার ফলে, একটু বৃষ্টি হলেই ক্লাসরুমগুলোতে পানি জমে যেত। উপস্থিতির হার নেমে আসতো শূন্যের কোঠায়। সেসব দিনে যারা স্কুলে আসতো, তাদের আর নিয়মিত ক্লাস হতো না। স্যারেরা তাঁদের জীবনের নানান স্মৃতি-গল্প-কৌতুক বলেই সময়টা পার করে দিতেন। এমনই এক ঝড়ের দিনে মহামান্য ‘প্রিন্সিপাল স্যার’ ক্লাস ওয়ানে এসে জানলেন, এই ক্লাসে নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি নেই! এমনকি এই ক্লাসের বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব (পড়ুন ক্যাপ্টেন) এর আগের দুটি ক্লাসে অর্থাৎ নার্সারি ও কেজি জিরো-তে অবৈধ সরকার গঠন করে ‘ক্যাপ্টেন’ পদে দীর্ঘ সময় আসীন ছিল! পাঠক বুঝতেই পারছেন কে ছিল সেই অবাধ্য-অবৈধ-স্বৈরশাসক! তো ক্লাসের সবার সম্মতিক্রমে ঠিক করা হলো, আগামি যে ক্লাসে উপস্থিতি সংখ্যা বেশি থাকবে সেদিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এই নির্বাচন কমিশন মনে করে, দলমত নির্বিশেষে সকলেই ক্যাপ্টেন পদে দাঁড়াতে পারবে। তবে আমি তা মনে করিনি! আমার ধারণা ছিল অন্য কেউ কেন ক্যাপ্টেন পদে দাঁড়াবে! এ পদের জন্য একমাত্র সুযোগ্য প্রার্থী হলাম আমি – এই ছিল আমার শিশু মনের একটি ভ্রান্ত ধারণা। তবে সুখের সংবাদ, সঠিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। সে নির্বাচনে স্কুলের অধ্যক্ষ মহোদয় (আমার বাবা) ছিলেন একাধারে প্রধান এবং একমাত্র নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার! বলতে দ্বিধা নেই, নিজের বাবা যদি নির্বাচন পরিচলানা করে থাকেন, সে হিসেবে পুত্র হয়ে কিছু সুনজরের দাবীদার আমি অবশ্যই ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমি এ সুনজর আদায় করতে পারিনি। বরং নির্বাচন চলাকালীন তাকে অসম্ভব পেশাদার এবং অতি অ-পিতৃসুলভ আচরণ করতে দেখা গিয়েছিল! ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন, নির্বাচনে বিপুল ব্যাবধানে জয়ী হলাম আমি! সেই আমার প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতাদখলের স্বাদ! এর পরের তিন বছর আমাকে ভাবতে হয়নি। কোনো বার অক্ষয় স্যার, কোনো বার গণেশ স্যার বাকি ক্লাসগুলোতে নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। ভিন্ন কোনো উপায়ে স্যারদের সুদৃষ্টি না পেলেও ফোর পর্যন্ত টানা চার বার আমিই ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হই! ক্লাস ফাইভে ওঠার পর জানতে পারলাম, সেবছর স্কুলে ভিপি নির্বাচন হবে। স্কুলের ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত সবাই প্রত্যক্ষ ভোট দিয়ে একজন ভিপি ও একজন জেএস নির্বাচন করবে। ভিপি মানে হলো ভাইস প্রেসিডেন্ট। গোটা স্কুলের ক্যাপ্টেন বা প্রিফেক্ট টাইপ কিছু একটা। আর জেএস হলো জেনারেল সেক্রেটারি। এই দুই টার্ম জানবার পরে আমার আর রাতে ঘুম হয় না। কি উপায়ে আমি ভিপি হবো?! এ চিন্তা-প্রশ্ন-উদ্বেগ আমাকে সদা ব্যস্ত রাখলো। দিন দিন নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছিল। আমার বিপক্ষে ভিপি পদে দাঁড়িয়েছে বন্ধু মুনায়েমুর রহমান সোহাগ। আর আমার প্যানেলের জেএস পদে পদপ্রার্থী চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া ছোটভাই রাজিউর রহমান রাসেল। রাসেল আর আমি সাথে আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে নেমে পড়লাম নির্বাচন প্রচারণার কাজে। বলতে দ্বিধা নাই, সোহাগের অবস্থান নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আমার থেকে শক্ত ছিল এবং সে যথেষ্ট যোগ্য প্রার্থীও ছিল বটে। এ নির্বাচন কমিশন ছিল বিস্তৃত এবং বিধিনির্দিষ্ট। মোশলেউর স্যার, অক্ষয় স্যার, মকবুল স্যার, গণের স্যার, রশিদুল স্যার প্রমুখেরা ছিলেন এ নির্বাচনের দায়িত্বে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় স্কুলের সব ক্লাস শেষ হবার পর এবং আমার মার্কা ছিল ‘আনারস’। আমার প্যানেলে যারা প্রচারণা করেছিল তাদের মধ্যে সুজন, সুমন, রাজু, লিংকন, রিকন, পিংকিদের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে। তাদের জোরদার প্রচারণায় এবং ভোটের দিনে আমার ‘চ্যুইংগাম’ বিতরণ প্রোগ্রামের কল্যাণে, আমি বন্ধু সোহাগকে মাত্র কয়েক ভোটের ব্যাবধানে হারিয়ে ভিপি নির্বাচিত হই! নির্বাচনের ফলাফল দেওয়া হয় ভোট গ্রহণের পরেরদিন। যদিও অলিখিতভাবে সেদিন সন্ধ্যায়ই আমারা ফলাফল জেনে গিয়েছিলাম। পরদিন এসেম্বলিতে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত ভিপি ও জেএস-এর নাম ঘোষণা করা হয়।

একটা বিষয় লক্ষ করেছিলাম, নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সবথেকে উদ্বিগ্ন ছিলেন আমার মা! নির্বাচিত ভিপি হিসেবে কি কি দায়িত্ব পালন করেছিলাম সে গল্প আরেকদিন বলব।

অষ্টধাতুনামাঃ

আমার শৈশবের একটা বিরাট চমকপ্রদ অধ্যায় হচ্ছে নেকমরদ হাটের দিন। অর্থাৎ রোববারের হাটের দিন। যদিও এই রবিবার হাট সমাচার নামে আরেকটা অধ্যায় হবে, সে অধ্যায়ের বেশ খানিকটা জুড়ে থাকবে ‘অষ্টধাতু’ আংটি বিষয়ক কীর্তন। এখন ভাবছি সেটাকে আর বড় করব না। এই অষ্টধাতু সংক্রান্ত গল্পটা এখানেই সেরে দেই।

রবিবারের হাটে অনেকগুলো ছোটছোট অস্থায়ী-একদিনস্থায়ী কিছু দোকান বসতো। এগুলার মধ্যে খাবার সংক্রান্ত কিছু বাকিগুলো বেশিরভাগই থাকতো পুরুষ মানুষের গোপন রোগ বিষয়ক। আরেক ধরণের দোকান বসতো, অষ্টধাতুর আংটি নিয়ে। উফ, কি যে এক আবেগের নাম। আংটিগুলো দেখলেই হতো, সোনা-রুপা কোন ছাড়, এই জিনিসের উপরে কিছু নাই। অবশ্য আমার এ বিষয়ে আগ্রহের আরেক কারণ, বাল্যবন্ধু সুজনের হাতে সবসময় একটা করে অষ্টধাতু আংটি। সেটা দেখে আমার শিশুমনেও পড়বার লোভ হতো! এই আংটিগুলো দুই ধরণের হয়। একটা তামা বা সাধারণ পিতলের আংটি। আরেকটি তামার তৈরি কাঠামোতে আটটি ধাতুর মিশ্রণ বসানো আংটি। লোকমুখে প্রচলিত এ আটটি ধাতু হলঃ সোনা, রূপা, তামা, পিতল, কাঁসা, রাং, সীসা ও লোহা। আমার মতে বাজারের আংটিগুলোতে এই সবগুলো থাকা সম্ভব না। কারণ, সেসময় একটা সাধারণ তামার আংটির দাম ছিল পাঁচ টাকা। আর অষ্টধাতুর আংটির দাম ছিল একুশ টাকা। একুশ টাকার মধ্যে যত অল্প করেই হোক, সোনা রুপা সীসা এতোকিছু  দেওয়া সম্ভব না!

আমি ছিলাম গরীব আদমি। আমার হাতে সপ্তাহ শেষে পাঁচটা টাকা জমলেই নিজেকে পৌনে কোটিপতি ভাবতাম। বেশ কয়েক সপ্তাহ জমিয়ে এই দীনহীন বেচারার কপালে শেষমেশ একটি সাধারণ তামার আংটি জুটল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই আমি আর কখনই ‘একুশ টাকার’ সেই অষ্টধাতু আংটিটি কিনতে পারিনি! সে অষ্টধাতু এ শিশুমনে অষ্ট প্রহর যে অষ্টব্যঞ্জনের অতৃপ্তি তৈরি করতো তা ছিল সামর্থ্যের বাহিরে, যাকে ইংরেজিতে বলে Affordability! আজ সে তের অক্ষরের সাধ্য থাকা সত্যেও নেই আটপ্রকোষ্ঠের সে সাধ! জীবন কি অদ্ভুত না?!

বেশি সিরিয়াস কথা বলে ফেলছি। একটু হালকা কথা বলা যাক। তো সেই তামা তথা আমার সাধ্যের অষ্টধাতুর আংটি পড়ে দিনরাত বসে থাকি। বাসায় কেউকে থোরাই কেয়ার করি না। কে কী ভাবল তাতে আমার কিছু আসে যায় না টাইপ অবস্থা আর কি! এর মাঝে একদিন বিকালবেলা স্কুলের টিনের ওপরে উঠে খেলছিলাম কজন মিলে। হঠাৎ স্কুলের ‘প্রিন্সিপাল স্যার’, যিনি আমার নিকটাত্মীয়(!), চলে এলেন বাইক হাকিয়ে। একেবারে স্কুলের মাঠের মধ্যে! আর আমরা যাই কই? যথারীতি নামিয়ে আনা হলো সবাইকে। রীতিকে সাড়ম্বরে পালন করে সবচেয়ে বেশি মার খেতে হলো আমাকে! কারণ তিনি আমার নিকটাত্মীয়! অতি নিকটের মানুষ, আমার বাবা! মারপর্ব চলার মাঝে অক্ষয় স্যার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন আমাকে বাঁচাবার। কিন্তু স্যার বেচারার হাতেও কয়েকটা পড়েছে [এই স্যারকে কখনও সেজন্য ধন্যবাদ পর্যন্ত দেইনি!]। মার খেয়ে যখন আমি পর্যুদস্ত, আবিষ্কার করলাম বাম হাতের আঙ্গুলটা ফুলে কলাগাছের মতো হয়ে গেছে! ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলাম আমার সে শখের আংটিটা বাঁকা হয়ে চেপে বসে গেছে আঙ্গুলের সাথে। টানাটানি করে খুলবার কোন উপায় নেই। এও বুঝলাম, হাতের ফোলাটা কমলেও কোনো পথ নেই আংটিটা বের হবার। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বাসায় গিয়ে আম্মুকে তো আর হাত দেখাই না! কি করা যায় ভাবছি। মনে হচ্ছিল এ আংটি আমার আঙ্গুলে সারাজীবন লেগে থাকবে। আর কোনদিন খুলতে পারব না! কীসের জন্য আসলে জানি না মনের ভেতরে এক গভীর বেদনা আর শোকের ছায়া নেমে আসল। এখন মনে পড়ছে না শোকটা আঙ্গুল নাকি আংটির জন্য ছিল।

শেষমেশ দ্বারস্থ হলাম এলাকার প্রসিদ্ধ স্বর্ণকার লেবু বাণিয়ার দরবারে। দরবারে না। তার স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে। তিনি দেখে একটু কৌতুক করে বললেন, ‘ইঁডা তো জীবনে নি খুঁলবা পাঁরবো রেঁ বাঁউ। তোঁক সাঁরাজীবনে পড়ে থাকপা হোবে এইখান। মি পাঁরিম নি।’ তার কৌতুক কীভাবে হজম করেছিলাম মনে নেই। তবে কিছুক্ষণ পরে তিনিই আমার হাতটা একটা পাথরের উপর রেখে ছোট্ট একটা হাতুরি দিয়ে খুব আসতে আসতে পিটিয়ে সে আংটিটা কিঞ্চিৎ সোজা করে দিয়েছিলেন। বাকিটা তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। হাতে সাবান আর পানি নিয়ে কিছুক্ষণ আঙ্গুলে ডলাডলি করতেই বের হয়ে এসছিল সে আংটিটা! আহারে, এই এক জিনিস কতই না ইতিহাসের সৃষ্টি করল! এখন ভাবলে হাসি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এই অষ্টধাতুপ্রীতি বজায় ছিল। পরে আর ভালো লাগতো না কেন জানি। এখন আট-দশ বছর বয়সী কারো হাতে সে আংটিগুলো দেখলে ভাবি ওদের মনেও কি সে অষ্টপ্রহরের অপূর্ণ সাধগুলো জমে আছে?

মন্তব্য করুন