[ ব্লগটি ব্লগ | হিউম্যানস অব ঠাকুরগাঁও এ জানুয়ারি ২২, ২০১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ]

ভাষাসৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম

ভাষাসৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম

ক’দিন থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ছি। এর মধ্যে একজন রাজনীতিকের নাম বারবার এসেছে। তিনি হচ্ছেন, ভাষাসৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম সাহেব। তার সম্পর্কে কীভাবে লিখব কোত্থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এটুকু বলে শুরু করি, তিনি আমাদের ঠাকুরগাঁও-এর সন্তান এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রথম সভাপতি।

আমরা যেসময়ে ঠাকুরগাঁও জিলা স্কুলে পড়েছি, সেসময়ের জাতীয় রাজনীতির ধারাটা কিঞ্চিৎ ভিন্ন থাকবার কারণে কি না জানি না, এই মহান ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানবার সুযোগ হয়নি। স্কুলের নাম টানলাম একারণে যে, অনেকেই হয়তো জানেন না, তিনি আমাদের এই স্কুল থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেসন পাস করেন!

মরহুম দবিরুল ইসলাম তত্কালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার বালিয়াডাঙ্গির বামুনিয়া গ্রামে ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। লাহিড়ী এম ই হাই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজশাহী বিভাগীয় ‘মায়াদেবী উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতা’য় লাভ করেন স্বর্ণপদক। এরপর ১৯৩৮ সালে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও হাই স্কুল (পরবর্তীতে ঠাকুরগাঁও গভঃ হাই স্কুল এবং বর্তমানে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এর পর তিনি ভর্তি হন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজশাহী সরকারি কলেজে। এখান থেকে প্রথম বিভাগে মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন! ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই দিনাজপুরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য তখনই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন দবিরুল ইসলাম। তাই ১৯৪৬ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে ডাক পড়ে তাঁর। সেই সম্মেলনে দবিরুল ইসলামের সঙ্গে আরো যোগ দেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, আব্দুর রহমান চৌধুরী, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ। সেদিন গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে এক আগুনঝরা বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তত্কালীন ছাত্রনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। এরপর ১৯৪৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলে আহ্বায়ক হন রাজশাহীর নঈমুদ্দিন আহম্মেদ। নবগঠিত এই কমিটিতে ফরিদপুর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লা থেকে অলি আহাদ এবং দিনাজপুর থেকে দবিরুল ইসলামসহ মোট ১৪ জন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হন। কমিটির নেতাদের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, মেধা আর পরিশ্রম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়াকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়। চলতে থাকে পাকিস্তানবিরোধী ও রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার দুর্বার আন্দোলন। সারা দেশের মতো দিনাজপুরেও ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের উত্তাপ। তখন দিনাজপুরে দবিরুল ইসলাম, নুরুল হুদা, কাদের বক্স (ছোটি ভাই), এম আর আখতার মুকুলসহ অনেকেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বর্তমানে সরকারি মহিলা কলেজ) এক ছাত্র জনসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন দবিরুল ইসলাম। দিনাজপুর জেলখানায় তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। বেয়নেট দিয়ে তাঁর বুকে আঘাত করা হয়। নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচারের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য চিরতরে ভেঙে যায়। বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন নেতা দবিরুল ইসলাম ও অন্য ছাত্রনেতাদের প্রতি এ রকম নির্যাতনের খবর শুনে দিনাজপুরে ছুটে যান। যার ঘটনা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ রয়েছে। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলন বেগবান করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও দবিরুল ইসলামসহ মোট সাতাশ জনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন এবং বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়।

এদিকে রাষ্ট্রভাষা অধিকার বাস্তবায়নের দাবির মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান এক লেখায় লিখেছেন ৪ জানুয়ারি, যা সম্ভবত সঠিক তারিখ নয়) ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে দবিরুল ইসলাম ঢাকা জেলখানায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্রনেতাদের সার্বিক সম্মতি ও মতামতের ভিত্তিতে দেশের ইতিহাসে দবিরুল ইসলামকে ছাত্রলীগের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। কমিটি হওয়ার কিছুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়েন তিনি। আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (যুক্তফ্রন্ট) থেকে ঠাকুরগাঁও আসনের জন্য মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মুসলিম লীগের তত্কালীন বাঘা নেতা নুরুল হককে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন দবিরুল ইসলাম। পরে ১৯৫৪ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিলে আবারও পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব দেশজুড়ে তুঙ্গে ওঠে। এরই মধ্যে ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন দবিরুল ইসলাম। তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম) নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সুগার মিল স্থাপনের জন্য তত্কালীন সরকারের কাছে জোরালো দাবি তুলে ধরেন।

বারবার কারাভোগ এবং জেলখানার ভেতরে অমানুষিক নির্যাতনের কারণে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিকই, তার পরও দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে রাজপথে নিজেকে সর্বদা সরব রেখেছিলেন। দিনাজপুর কারাগারে তার উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এতে তার হার্টের একটি ভাল্ব নষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আন্দোলনের এ অগ্রসৈনিক, বিরল প্রতিভার অধিকারী মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তাঁর নিজ গ্রাম বামুনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

আমার জানামতে, মরহুম দবিরুল ইসলামের মৃত্যুর এত বছর পার হলেও আজও তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি বা সম্মাননা দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয় অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে ঠাকুরগাঁও সাধারণ পাঠাগার চত্বরে তার ম্মৃতিস্তম্ভ। তার স্মৃতিস্তম্ভটি এমন জায়গায় নির্মিত যেখানে মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্যেও ফুল দিতে যেতে পারে না। প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়নি বিরল প্রতিভার অধিকারী এই রাজনীতিবিদকে। মরহুম দবিরুল ইসলামের সন্তান জনাব আহসান উল্লাহ ফিলিপ বর্তমান মাননীয় সরকারপ্রধানের কাছে দাবি করেছেন যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর পিতাকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য তাঁর অসামান্য অবদান ও তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে তাঁর মূল্যায়নের জন্য ঠাকুরগাঁও শহর থেকে লাহিড়ী হাট পর্যন্ত সড়কটির নাম ‘ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলাম সড়ক’ নামকরণ করা হয় এবং তাঁর নামে ঠাকুরগাঁও জেলায় সরকারিভাবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়।

দাবিগুলোর সাথে আমি নিজেও একমত পোষণ করছি। কমপক্ষে আমাদের ঠাকুরগাঁও-এর তরুণ সমাজ এবং শিক্ষার্থীরা দুটি বিষয় জানুক। এক, ঠাকুরগাঁও-এ এমন একজন অসম্ভব মেধাবী জন্মেছিলেন যা আমদের জন্য বিরাট গর্বের বিষয়। দুই, ছাত্র রাজনীতিতে সেসময়ে মরহুম দবিরুল ইসলামের মত অদম্য মেধাবীরা সক্রিয় অংশ নিত বলেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং এগারো দফা আন্দোলন, আর সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মত বড় বড় রাজনৈতিক আন্দোলনে আমাদের বিজয়গুলো এসেছে।

এই মহান ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর সাতান্ন বছর পরে ঠাকুরগাঁও জেলার নিতান্ত একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

তথ্যসূত্রঃ

  • অসমাপ্ত আত্মজীবনী
  • জেলা তথ্য বাতায়ন
  • দৈনিক জনকণ্ঠ
  • দৈনিক কালেরকন্ঠ

This article has 1 comments

  1. Amit Basak Reply

    অসাধারণ একটা মানুষের সম্পর্কে অসাধারণ একটা লেখা।

মন্তব্য করুন