আমাদের পথচলা আমাদের পথে (পর্ব ২)

পড়শু ঈদ। আজ অফিসে শেষ কর্মদিবস। সবাই খুশি খুশি মনে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। আমার মন কিছুতেই খুশি হতে পারছে না। এর কারণ দুটো। এক, আমি এখনও স্যালারি পাইনি (বোনাস তো দূর কি বাত)। দুই, এ ঈদে বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণটা যে প্রথম কারণেরই উপজাত তা আর নিশ্চয়ই বলা লাগে না! অর্থনৈতিক মন্দার পরিণামে বাড়ি যাচ্ছি না আমরা। এ নিয়ে নিরুর খুব একটা মাথাব্যথা হবার কথা না। জানি না কি হবে। ওর ধারণা আজকে অবশ্যই আমাকে হাতে কিছু না কিছু ধরিয়ে দিবেন সেলিম ভাই। সেলিম ভাই আমাদের অফিসের একাউন্টেন্ট। ভদ্র নম্র চমৎকার মানুষ। সারাদিন অনলাইন সংবাদ পোর্টালগুলো পড়েন। অদ্ভুত সে সংবাদ মাধ্যমগুলোর নাম। যেমন, আজকেরতাজাখবর২৪ডটকম। এই পোর্টালগুলোর লোকেরা যেভাবেই হোক নামের সাথে ২৪ সংখ্যাটা জুড়ে দিতে পটু। আর তাদের সংবাদগুলোও সেরকম। ঠিক এই মুহূর্তে সেলিম ভাইয়ের স্ক্রিনে যে সংবাদ পোর্টালটা আছে, তাতে লেখা ‘বিমান বন্দরে দু’বস্তা চালসহ প্রবাসী আটক’। এক লোক নাকি বিদেশ থেকে সোনাদানা না এনে দুই বস্তা চাল এনেছে! তার উদ্দেশ্য আত্মীয়দের মাঝে পাঁচ কেজি করে চাল বিতরণ। তিনি কঠোর ভাবে জানিয়েছেন, চাল নিয়ে আসা অপরাধের কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক চালের যে দাম বেড়েছে তাতে লোকের এ কাজ আমার কাছে শতভাগ যুক্তিসঙ্গত। তো সেলিম ভাই আর যে কাজটা করেন সেটা হল ফেইসবুক চালানো। আমাদের গ্রাফিক্সের মাস্টার শাহিন ভাইয়ের মতে, সেলিম ভাই ফেইসবুকে আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ তাকে ‘জ্যেষ্ঠ গুণনিশ্চিতকরণ কর্মকর্তা’ পদে নিয়ে নিবে। তো এই শান্ত চেহারার মানুষটা বেতন দিবার সময়গুলোতে দিগুণ অস্থির হয়ে যান। মুখ হয়ে যায় গোমরাভাব। অফিসের আর সবার সাথে অপরিচিতের মত আচরণ করেন। তবে তার এ ভাবভঙ্গিটাও দেখতে ভালো লাগে তিনি যখন বেতন বিতরণ শুরু করেন।

 

যেদিন তিনি আমার পুরো নাম ধরে ডাকেন সেদিন আমার উত্তেজনার সীমা থাকে না। যেটাকে ইংরেজি সিনেমায় বলে ‘ক্লাইমেক্স’। আচ্ছা ক্লাইমেক্স এর ভালো বাংলা কি হতে পারে? তৎক্ষণাৎ গুগল ট্রান্সলেটরে দেখলাম এর বাংলা অর্থ করে দিল ‘পরাকাষ্ঠা’। শব্দটা একটু কেমন যেন! শব্দটা কানে আসলেই মনে হয় কোষ্ঠকাঠিন্য শব্দটার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে! যাই হোক, সেলিম ভাই পুরো নাম ধরে ডাকার মানে হল তিনি যে খামে আমার নাম লিখেছেন তা তিনি পড়ে শুনিয়ে আমাকে ডাকছেন। আর খামে কি আছে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন! কিন্তু আজ তেমন কিছুই হল না। খুব সাদামাটা আর দশটা দিনের মত অফিস করে মুখটা যতটা পারা যায় স্বাভাবিক করে অফিস থেকে বের হবার প্রস্তুতি নিলাম। অবাক হয়ে বুজতে পারলাম, যতই চেস্টা করছি মুখটা কেমন ঝুলে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের কান্নার আগের মুহুর্তের মত। যথাসম্ভব দ্রুতপায়ে অফিস থেকে নেমে গেলাম। ইদানিং সাইকেলে করে অফিসে যাতায়াত করা শুরু করেছি।

নিরু মনে করে এতে আমার ওজন কমবে এবং দেহাবয়ব(ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফিগার’) ঠিক হবে। পুরো সাত কিলোমিটার রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি পড়ে বিজয় সরণি। সিগনালটা পার হবার পর বুঝতে পারলাম যত শক্তি দিয়েই চালাই না কেন, সাইকেলটা আগাচ্ছে না। থামিয়ে নিরীক্ষা করে বুজলাম, সামনের চাকায় কিঞ্চিৎ একটি ছিদ্র হয়েছে। এ নৃশংস বাস্তবতার দায়ে দোষী বস্তুটিকে খুঁজে পেলাম। স্টেপল এর একটা পিন! মেজাজ যার পর নাই খারাপ হয়ে গেল। আর ঠিক তৎক্ষণাৎ ক্ষীরে গুড় ঢালবার অনুরূপ একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটল। মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হল। মেজাজটা এবার কতটা অসংযত এবং অসংলগ্ন ভাষা উদ্‌গিরনের কারণ হয়ে উঠল তার চিত্ররূপ সংযত পাঠক নিজ মনে এঁকে নিবেন!

 

প্রায় আধাকিলো হেঁটে ভিজে কাক হয়ে একজন সাইকেল মেরামতকারির দেখা পেলাম। তিনি বললেন, ‘শাইক্যাল শাইডে রাখেন। একটা রিশকার ডাইন চাক্কা ঠিক করতাছি। পৌনে আধঘন্টা লাগবো।’ আমি কোনভাবেই ভেবে পেলাম না পৌনে আধঘন্টা মানে কি? আচ্ছা পিএসসি এই ধরণের পেঁচানো অঙ্ক তাদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কি দেয়? এরকম প্রশ্ন আসল হয়ত, ১। পৌনে আধঘন্টা সমান কত মিনিট, কত সেকেন্ড? ২। একটি ঘোড়া ঘন্টায় পৌনে সাড়ে পঁচিশ কিলোমিটার যেতে পারে। পৌনে আধঘন্টায় এ ঘোরাটি কতদূর যাবে তা মিলিমিটারে লেখ? আচ্ছা ওরা ‘লেখ’ বলে না ‘লেখেন’ বলে? আপনি না তুমি? এ জটিল বিষয়টি নিয়ে বিশাল চিন্তায় পড়ে যাবার আগেই টের পেলাম আমাদের সাইকেল মেরামতকারি ভাই আমার নব্য ক্রীত সাইকেলটাকে কাঁত করে শুইয়ে দিয়েছে। মুহূর্তেই আক্রান্ত চাকার টিউব খুলে ফেলা শেষ। আমি ঘড়িতে দেখলাম রাত সাড়ে আটটা বাজে।

নিরুর ক্ষুদেবার্তা এলো ফোনে। লেখা আছে, ‘বের হইসো? বেতন দিসে?’ আমি উত্তরে লিখলাম ‘না’। পাঠাবার আগে ভাবলাম এই একটা না দেখে নিরু রেগে যাবে। ও যতগুলো প্রশ্ন করেছে তার সবগুলোর উত্তর না পেলে ও খুব রেগে যায়। না কেটে ‘হ্যা’ লিখলাম। কিন্তু এর অর্থ এই দাড়াতে পারে যে আমি বেরও হয়েছি, বেতনও পেয়েছি। এই একটি ‘হ্যা’ নিরুর প্রশ্নের দুটি চলককে গুন করে দিতে পারে! আর যদি লেখি ‘হ্যা, না’ নিরু পৌনে তিনগুণ রেগে যাবে! বাসায় প্রবেশ করা মাত্র চিল্লাচিল্লি শুরু করবে, ‘এর অর্থ শুধু প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেই হবে? হ্যা, না, হ্যা, হ্যা, না, না, না। এরকম উত্তরই তোমার সারা জীবন? আর কিছু লেখা যেত না? আমি কি করছিলাম না করছিলাম একটু জিজ্ঞেস করা যায় না? বল গত বছর বড় চাচার ছেলের বিয়েতে যে শাড়িটা পড়েছিলাম তার রঙ কি ছিল? জানি তো বলতে পারবা না। তোমার তো আমার ব্যাপারে কিছুই মনে থাকে না। খালি নিজেরটাই। সেলফিশ ছোটলোক।’ এমন সময় আমি হয়তো বলব, ‘নিরু সেলফিশ মানেই তো ছোটলোক। শব্দের দ্বিরুক্তি হয়ে যাচ্ছে না?’ এমন অবস্থায় নিরু অগ্নিরূপ ধারণ করে ঘোষণা দিতে পারে, ‘আজ থেকে এ বাসায় তোর পৌনে দুই দিন খাওয়া বন্ধ! দেখি কুন বান্দি তোকে খাওয়া দেয়!’ আমার সম্ভাব্য কর্মের ভিন্ন ভিন্ন ফলাফলের ভয়াবহতা চিন্তা করে নিরুকে লিখে পাঠালাম, ‘নিরু, ঢাকার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা!’। হ্যা/না জাতীয় উত্তরের থেকে এ লাইনটাই আমার কাছে নিরাপদ মনে হল। বাসায় ফিরে আমার উপর যে দুর্যোগ নেমে এল তা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার মর্মস্পর্শী বেদনাকেও হার মানায়। সেদিন আমার সময়রেখায় কি দুর্নিবার বিপর্যয় হানা দিয়েছিল তা আরেকদিন বলব। আর ঈদটা কেমন গেল তাও না হয় শোনা হবে।

[ বুদ্ধিমান পাঠক বলুন তো, পৌনে আধাঘণ্টা সমান কত মিনিট? ]

 

আমাদের পথচলা আমাদের পথে (পর্ব ৪)

This article has 1 comments

  1. Pingback: আমাদের পথচলা, আমাদের পথে (পর্ব ৪) | অর্বাচীনের জার্নাল

মন্তব্য করুন