আমাদের পথচলা আমাদের পথে (পর্ব ৩)

ঈদের পরে পুরোদমে অফিস চলছে। নিরুও ব্যস্ত। কোর্টে যায় মাঝে মাঝে। ওখানে ওরা কি কাজ করে এ ব্যাপারে আমার ধারণা শূন্য। আমি অফিস করি সেই যন্ত্রণাদায়ক সাইকেলটা নিয়ে। এর মাঝে আলাদা করে তিন দিন অফিস ফাঁকি দেওয়া হয়ে গেছে। গত পড়শু এমডি স্যার ডেকে পাঠালেন। বললেন, তোমার যাতায়াতের ঠিক নাই কেন? আমি সঙ্গে করে একটা দরখাস্ত নিয়ে গিয়েছিলাম। তৎক্ষণাৎ স্যারের সামনে পেশ করলাম। তিনি বললেন, তোমার এই ছুটির (তাঁর উচ্চারণটা হয় ‘সুটির’) দরখাস্ত আমি এক শর্তে গ্রহণ করতে পারি, যদি তুমি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো। আমার ধুকপুকানি বেড়ে গেল। একটা ঢোক গিলে বললাম, জি স্যার। আচ্ছা স্যার। তিনি বললেন, আজ আমাদের ‘সুটি’ ও ভাই, আজ আমাদের ‘সুটি’ ছড়াটা কার? নজরুলের না শামসুর রাহমানের? আমি না ভেবেই বলে ফেলছিলাম, শামসুর রাহমান। তৎক্ষণাৎ আমার মগজের কোন এক কোণে একটা সুর বেজে উঠল- ‘আহা হা হা হা… আহা হা হা হা…’। ছোটবেলায় যখন হারমোনিয়াম নিয়ে বসতাম, এই সুরটাই প্রথম প্রথম শিখেছিলাম। চট করে প্রথম লাইনটা মাথায় চলে এল, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুঁটি, আহা হা হা হা…। এবং স্কুলে একটা কম্পেটিশনে এই গানটা উপস্থাপনও করেছিলাম। এ গান গেয়ে যে বিভাগ থেকে তৃতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলাম, সে বিভাগের নাম ছিল ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’। যার অর্থ দাঁড়ায় এই বিভাগের কিঞ্চিৎ পরিমাণ সাহিত্যকর্ম কোনভাবেই শামসুর রাহমান সাহেব লিখতে পারেন না। আচ্ছা শামসুর রাহমান কি এরকম ছড়াগান লিখে গেছেন? কেন ওই যে, ঝকঝকা ঝক ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই? কিন্তু ওটাতে সুর চড়ানো হয় নাই মনে হয়। ভাল কথা, রবীন্দ্রনাথের গান যদি হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শামসুর রাহমানের গানের ক্ষেত্রে সেগুলোর নাম কী হতে পারে? ‘শামসু সঙ্গীত’? এসব ভাবতে ভাবতে মনে হল বড্ড বেশি সময় নিয়ে ফেলছি। স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললাম, স্যার এই ছড়াগান কবিগুরুর। আমি নিশ্চিত কি না স্যার জিজ্ঞেস করলেন। আমি নিশ্চিত বলার পরে স্যারের মুখে মৃদু হাসি দেখতে পেলাম। বললেন, তোমার দরখাস্ত আমি গ্রহণ করলাম।

অফিসের নানান কাজের ভীরে এরই মাঝে একদিন যেতে হল বিড়াল কিনতে। কাঁটাবনে। বিড়াল জিনিসটার প্রতি আমার অতোটা দরদ না থাকলেও নিরুর তা ভয়ানক। বিড়াল নিয়ে ও সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারে। ওর আবদার রাখতেই একটা ছোটখাট সাইজের বিড়াল কিনলাম। ক্যালিকো জাতের। এই পুঁচকে প্রাণীটার দাম দিতে হল সাড়ে আট হাজার টাকা! আমার ওয়ালেটের দফারফা হয়ে গেল। তারপরেও ভাল লাগল। নিরুর সখ। ওর খুব ইচ্ছা একটা বিড়াল থাকবে বাসায়। ঘুরঘুর করবে। সঙ্গে ক্যাটফুডও কিনলাম। আগোরাতে পাওয়া যায়। ৭০০ টাকায় এক মাস চলে। আহারে। আমাদের মফস্বলের বাসায় এমন একটা বিড়াল ছিল কিছুদিন। বাসার লোকদের পা ধরতে চাইতো সবসময়। মনে হতো ক্ষমা চাইছে কৃতকর্মের জন্য। সে বিড়ালের কল্যাণে বাসায় কোন তেলাপোকা এবং ইঁদুর ছিল না। বাসার সকল উচ্ছিষ্ট খাবার বরাদ্দ ছিল তার জন্য। আর এখানকার বিড়ালের জন্য সুপারশপ থেকে খাদ্যসামগ্রী কিনতে হয়!

বিড়াল নিয়ে আসবার পর থেকে নিরুর সে কি আনন্দ! বিড়ালকে খাওয়ায়। গোসল করায়। হাঁটায়। মাঝে মাঝে পড়ায়ও! একদিন দেখলাম বিড়ালটাকে নিরু বলছে, কাল থেকে স্কুলে যাবে, ওকে? কোন দুষ্টামি করবে না স্কুলে। কাউকে খামচি দিবে না। বিড়ালটা খুব শান্ত হয়ে ওর কথা বুঝতে পারছে এমন ভঙ্গিতে নিরুর দিকে তাকিয়ে আছে। আমার তো মাথায় হাত। নিরুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বিড়াল স্কুলে যাবে ক্যামনে? এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। হুট করে একদিন ওর বিড়ালটার অসুখ করল। সারাদিন শুয়ে থাকে বিড়ালটা। আর পেট ওঠানামা করে। ঘুমাচ্ছেও বেশি মনে হচ্ছে। নিরু অনলাইনে একটা পেট সার্ভিসিং কোম্পানিতে ফোন করে একজন পশু চিকিৎসককে আনালো। সে পরীক্ষা করে বলল, কিডনির সমস্যা হতে পারে। অথবা থাইরয়েডের। কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেল লোকটা। সুখের সংবাদ হচ্ছে নিরুর বিড়ালটা সেসব ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়ে গেল। আগের মতই ঘুরে বেড়ায়, খায়। পড়ে! কিন্তু আমাদের জন্য একটা বড় দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। একদিন বিড়ালটা চুরি হয়ে গেল! চুরি হয়ে গেছে নাকি কোথাও চলে গেছে বিড়ালটা নিজেই এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। তবে নিরু নিশ্চিত যে চুরিই হয়েছে। কারণ এসব উন্নতজাতের বিড়াল নাকি পালায় কোথাও যাবে না। তারা মনিবের বাসাতেই যেহেতু ভাল খাওয়া-পড়া পায় তাই অন্য কোথাও যাবার প্রশ্নই আসে না। নিরু সিদ্ধান্ত নিল পুলিশকে জানাবে! আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। থানায় কেমন করে একটা বিড়ালের ব্যাপারে ডায়েরি করি! নিরুর চাপে অবশ্য তাই করতে হল। থানায় ওসি সাহেব ছিলেন না। তিনি থাকলে ভালই হতো। আমার পরিচিত। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। একই ব্যাচের। তিনি পড়েছেন বাণিজ্য বিভাগে। ওসি সাহেবের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত এসআই ভালই খাতির করলেন। কিন্তু মুচকি একটা হাসি লেগেই ছিল। যাতে আমি কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করতে থাকলাম। তরুণ এসআই বললেন, স্যার, এইসব বিলাই টিলাই খুঁজা আমাদের কাম না। পাড়ার মুধাবিতে (মুধাবি মানে সম্ভবত ডাস্টবিন বুঝাচ্ছেন তিনি) দুইডা লোক নামায় দেন, দেখবেন মরা বিলাই পড়ে আছে। আমি মনে মনে বললাম, তুমি বড় বাঁচা বেঁচে গেছো বাপু, ভাগ্যিস নিরু আসে নাই। ওর বিড়ালকে বিলাই ডাকার অপরাধে তোমার নামে কমপ্লেন করে যেত সে।

অবশেষে ‘বিলাই’ বাবাজিকে পাওয়া গেল বাসার ছাদে! নিরুকে বললাম, তোমার বিড়ালের মনে হয় সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। ছাদের খোলামেলা পরিবেশে সুখটান দিচ্ছিল বোধ হয়। নিরু বলল, কি যে বল না! বিড়াল ফিরে পাবার আনন্দে ও আর তেমন কিছু বলল না।

তো একদিন এক কলিগের বাসায় গেলাম দাওয়াত খেতে। ছোটখাট ঘরোয়া পার্টি। নিরু ঠিক করল ওর বিড়ালও সঙ্গে যাবে। আমি সেবার অনেক বুঝিয়ে নিরুকে নিরস্ত করলাম! বিড়াল নিয়ে এ সকল আহ্লাদের মাঝেই নিরু একদিন সিদ্ধান্ত নিল ও পাখিও পুষবে। শুক্রবার দিন দেখে যথারীতি রউনা দিলাম কাঁটাবন। দু’টা কবুতর নিলাম! ফিরবার পথে নীলক্ষেতে ঢু মারলাম একটু। কয়েকটা প্রয়োজনীয় বই কেনার ছিল। বইয়ের সমারোহ দেখে মনে হল, অফিসের ব্যস্ততা আমার তথাকথিত সাহিত্যচর্চার কতটা ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এবং এও মনে পড়ল, কতদিন কবিতা লেখা হয় না!

বাসায় ফিরে আমার আশা পূরণ করল নিরু। শুনেছি পাবলো নেরুদা নাকি রবিন্দ্রনাথের কবিতা মেরে দিয়েছিলেন। নেরুদারই একটা কবিতার বই পড়ছিলাম। দেখি, চোরের উপর বাটপারি করা যায় কি না (বুদ্ধিমান পাঠক আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন)! সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ করা নেরুদার কবিতাসমগ্র। যে কবিতা পড়ছি তার নাম ‘মাচু পিচুর শিখর থেকে’। পড়া শেষ করে কি মনে করে কলম চালাচ্ছিলাম কাগজের ওপরে। নিরু সোফায় বসে বিড়ালকে খাওয়াচ্ছিল। বলল, কি করছো? আমি বললাম, একটা অনবদ্য কবিতা লিখে ফেলেছি নিরু। শুনবে? নিরু আগ্রহ করে বলল, শোনাও। আমি সুতীব্র অনুভূতি দিয়ে আবৃত্তি শুরু করলামঃ

আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে…

নিরু থামিয়ে দিল। বলল, সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না। আমি বললাম, রবিদার আত্মা ভর করেছিল মনে হচ্ছে নিরু। নিরু এবার আহ্লাদ করে বলল, আমার বিড়ালটাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে দাও না। আমি প্রথমে একটু হতাশ হলাম, আমি বিড়ালের কবি? পরে মনে হল, বিড়াল নিয়েও কবিতা লেখা যায় আমিই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হতে পারি! আমি গভীর ভাবনা করবার ভঙ্গি করে বললাম, কোন চিন্তা করো না তুমি। কাল সকালেই গরম গরম কবিতা পাবে। কাল যেহেতু শনিবার। রাতটা আমি ভেবে ভেবে একটা কবিতা পয়দা করে ফেলব নিরুবাবু। নিরু খুশি হয়ে ঘুমাতে চলে গেল। আমার মাথায় ভর করল চিন্তা। কি লিখব? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম কবিতাটি হবে সাধু ভাষায়। তবে সব জায়গায় সাধু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি! কবিতার নাম ‘ভিজে বিড়াল’।

ভিজে বিড়াল

ভূমধ্যসাগর কিনারে, আলেকজান্দ্রিয়া শহরে

পিতা মোর তব তরে কাঁদিতেছে হু হু স্বরে,

পুড়িতেছে জান আজি , বক্ষের যাতনায়

পুত্র আজিকে চলিতেছে পাটনায়।।

পাটনার পথ ধরি আসিতেছি বঙ্গে

একগাঁদা ক্যালিকো যাইতেছে সঙ্গে,

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী

সহজাত প্রাণীকুলে গিয়াছে ভরি।।

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা

এক ধারে নাবিক আর, ওই ধারে দাদা,

দাদারে জিজ্ঞেসিলাম, তব খাইব আজি  কী?

‘আগোরার মাছ আছে, দাম দুই সিকি’।।

এইটুক লিখে মনে হল, কোন কবির ছাপ পড়ে যাচ্ছে মনে হয়। একটু বিশ্রাম নিয়ে বাকিটুকু লিখে ফেললাম।

যাত্রার শেষকালে আসিলাম কাঁটাবনে

ক্যালিকোর ভাব হল পারস্য-বিড়ালের সনে,

পরিশেষে বুঝিলাম শুভঙ্করের ফাঁকি

মনিবের গৃহকোণে আজি আমি থাকি।।

ভিজে ভেবে নিজে তব খাইলাম ধরা

আজি নিশি বক্ষে তব গেঁথে দিব ছোরা!

এই কবিতা পরদিন সকালে নিরু পড়বার পরে আমার কপালে কি জুটল পাঠক নিজ দায়িত্বে কল্পনা করে নিবেন!


(তথ্যঃ ক্যালিকো প্রজাতির প্রায়-তিন রঙা বিড়ালের আদি বংশানু বৈশিষ্ট্য মিশরের ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় পাওয়া যায়)

আমাদের পথচলা, আমাদের পথে (পর্ব ৫)

 

This article has 1 comments

  1. Pingback: আমাদের পথচলা, আমাদের পথে (পর্ব ৫) | অর্বাচীনের জার্নাল

মন্তব্য করুন