আমাদের পথচলা আমাদের পথে (পর্ব ১)

স্বপ্নের ঠিক এ পর্যায়ে বুঝতে পারলাম গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছি, নিরুকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে ওর চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, ‘মোষের মত ঘুমাচ্ছো কেন, ওঠো। এই ওঠো।’ মোদ্দা কথা, নিরু এক গ্লাস পানি আমার মুখে ছিটিয়ে ঘুম ভাঙানোর তার অভিনব কৌশলটি কাজে লাগাচ্ছিল এতক্ষণ! আমি শান্তভাবে উঠে বসলাম। ঘুমের ঘোরেই কি না জানি না নিরুকে অ্যানিভারসারির শুভেচ্ছা না জানিয়ে বলে বসলাম, ‘শুভ জন্মবার্ষিকী নিরু। জীবন আলোকিত হোক। মঙ্গলময় হোক মুহূর্তগুলো।’ এই লাইন তিনটা আমার বান্ধা লাইন। যে কারো জন্মদিনে অনলাইনে অফলাইনে এই তিন লাইন দিয়ে শুভেচ্ছা জানাই। নিরুর চেহারা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। তবে কিছু বলল না। শুধু বলল আজ কত তারিখ? আমি বললাম, ‘আজ ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ। বিশ্ব রেডিও দিবস। দেশবরেণ্য অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি কবছর আগে আজকের এই দিনে মারা যান। আজ থেকে ঠিক চারশ বছর আগে পোপ সপ্তম আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়। ১৯৩১ সালে আজকের এই দিনে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লিতে স্থানান্তর করা হয়।’ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। নিরু থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজ পহেলা ফাল্গুন গরু কোথাকার। আজ বসন্তের প্রথম দিন। এসব মনে থাকে না কেন?’ আমি একটু উদাস হবার ভান করে বললাম, ‘জগত রহস্য পছন্দ করে নিরু। কোন এক রহস্যময় কারণে আমার এটা মনে ছিল না। কসুর মাফ কিয়া জায়ে।’

নিরু কিছু না বলে উঠে গেল। কোন কাজ থাকলে তারাতারি সেরে আসতে নির্দেশ দিয়ে গেল। আমি পরিবেশ হালকা করবার জন্য কোন কাজ না থাকা সত্যেও বেরিয়ে পড়লাম। মাহবুব ভাইয়ের চায়ের দোকানে এককাপ চা অর্ডার করে একটা ড্রাই কেক মুখে দিলাম। আচ্ছা ড্রাই কেকের ভালো একটা বাংলা নাম দেওয়া যায় না? শুকনো পিঠা? নাহ। একটু কঠিন শব্দ দিতে হবে। যেমন, অনমনীয় পিষ্টক। পিষ্টক মানে পিঠা। বাহ! কি চমৎকার নাম। তৎক্ষণাৎ ঠিক করলাম বাংলা একাডেমিতে এ বিষয়ে একটি দরখাস্ত লিখব। পিষ্টক নিয়ে কবিগুরুর একটা কাহিনী মনে পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে থাকেন। এক শীতের বিকেলে আশ্রমের এক শিক্ষকের স্ত্রী পিঠাপুলি তৈরী করে নিয়ে এলেন কবির জন্য। রবীন্দ্রনাথ পিঠে পুলি খেতে খুব ভালোবাসতেন। সেইজন্যে অতিযত্ন নিয়ে শিক্ষকপত্নী তৈরী করেছেন পিঠেপুলি। পরদিন তিনি কবিগুরু কে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে গুরুদেব, পিঠে কেমন লাগল?’ রবীন্দ্রনাথ মজা  করে লাইন বেধে বললেন,

লোহা কঠিন, পাথর কঠিন

আর কঠিন ইষ্টক

তাহার অধিক কঠিন কন্যা

তোমার হাতের পিষ্টক।

যাই হোক। গুরুদেবের স্মৃতিতে মনোনিবেশ করতে গিয়ে আমার চা বরফ শীতল হয়ে গেল। এক ঢোকে সে চা গলায় ঢেলে দিলাম। এমন সময় ফোনে হিন্দি গান বেজে উঠল। আমার অতি পছন্দের নারী মোনালি ঠাকুরের ‘খোয়াব দেখে ঝুটে মুটে’ গানটি। আমি নিরুর নাম্বারে এই গানটা সেট করে রেখেছি। নটরডেমে পড়ার সময় আমাদের অংক করাতেন বিদ্যুৎ কুমার ভদ্র স্যার। তিনিও এই গানটি ফোনের ইনকামিং-এ সেট করে রেখেছিলেন। একবার কুইজ চলছে ২৩১ নম্বর কক্ষে সম্ভবত। খুব গম্ভীর একটা পরিবেশ। বিদ্যুৎ স্যার ডিউটিতে আছেন। পিন পতন নিরবতার মাঝে এ গান আসতে করে বেজে উঠল। সবাই মৃদু হেসে ফেলল। আমার হাসির শব্দটা কোন্ কারণে জানি না একটু বেশিই শোনাল। কলেজ কর্তৃপক্ষের আদেশে আমার খাতাটি ছিনিয়ে নিলেন নিখিলেশ স্যার। ডাকসাইটে তার যে ছদ্দনাম আমরা ব্যাঙ্গ করে বলতাম তা এই লেখায় উল্লেখ করবার যোগ্যতা রাখে না! সেদিন মনে মনে স্যারকে এক হাজার বার এই গালি দিয়ে চলে এসেছিলাম।

সে যাক। নিরুর ফোন ধরলাম। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কই তুমি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি মারস্-এ নিরুবাবু। মারস্ মানে মঙ্গল গ্রহ। সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ হচ্ছে এই মঙ্গল। নিরু তুমি কি জানো ব্রুনো মারস মঙ্গল থেকে আসেন নাই? আমি অবাক হই তার নামে কেন এই শব্দ থাকবে!’ নিরু ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ থাক শয়তান। এতো কথা বলিস না। কই তুই ঠিক করে বল?’ এটা নিরুর ছোটবেলার অভ্যাস। রেগে গেলে তুমি থেকে তুই-এ চলে আসে। তুই থেকে তুমিতে আসতে বেশ সময় লাগে। যেমন আজ সারাদিন তুই দিয়েই আমার সাথে কথোপকথন চলতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আমি শুনেছি পুলিশেরও এই রোগ আছে। মাথা গরম হলে নাকি আপনি থেকে তুই-এ আসতে লাগে কয়েক মুহূর্ত! আমি নিরুকে বললাম, ‘ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চিপায় চা খাচ্ছি নিরু। অনমনীয় পিষ্টক দিয়ে চা। বলতো অনমনীয় পিষ্টক কি?’ নিরু মুহূর্তেই বলে ফেলল, ‘ড্রাই কেক।’ আমি আরেকবার অবাক হয়ে এই রমণীর প্রেমে পড়লাম। জগতের সমস্ত মেধা সৃষ্টিকর্তা নিরুকে দিয়েছেন। কি বিচক্ষণতা! এবার নিরু বলল, ‘ড্রাই কেকের মোট ১৭ টি বাংলা নাম বের করেছো এর আগে তুমি। মনে নাই?’ আমার বিস্ময় খানিকটা কাটল। তবে নিরু অন্তত আমার থেকে ঢের বুদ্ধিমান এটা অস্বীকার করবার কিছু নেই। আমার তো মনেই ছিল না এই আবিষ্কার আমি আগেও করেছি! নিরু জিজ্ঞেস করল, ‘কখন আসবে?’ আমি ব্যস্ততার ছলনা করে বললাম, ‘তাও চারটা বাজবে।’ ও ধমক দিল। বলল, ‘তিনটার আগে বাসায় ঢুকবি। আর দর্জির দোকান থেকে কাঁঠালি রঙের পাঞ্জাবিটাও আনবি।’ আমি স্যালুট দিয়ে বললাম, ‘ইয়েস স্যার। আলবৎ স্যার।’ নিরু বিরক্তি নিয়ে ফোন রেখে দিল।

বাসায় এসে দেখি নিরু কাঁঠালি রঙের একটি শাড়ি পড়ে বসে আছে। আমি বললাম, ‘নিরু তোমাকে অসম্ভব রূপবতী লাগছে!’ নিরু বলল, ‘থাক ওসব কথা। ক্যামেরায় চার্জ আছে তো?’ আমি একটু ভরকে গেলাম। কদিন আগে বন্ধু কামাল ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিল। সে ক্যামেরাটাই দিয়ে যায়নি! আমি আসছি এক্ষুনি বলে দৌর দিলাম কামালের বাসার উদ্দেশ্যে। কামালের বাসায় গিয়ে দেখি কামাল গোসলে গিয়েছে। আমি কামাল কে গোসলখানার বাইরে থেকে বললাম, ‘কামাইল্যা, আমারে বাঁচা। ক্যামেরাটা কই রাখসিস ভাই একটু বল।’ কামাল ওপার থেকে বলল, ‘ওইডা তো আমার শালা ইমতিয়াজ নিয়া গেসে। কাইল তোর বাসায় দিয়া আসুমনে দোস্ত।’ বলেই কিলবিলিয়ে একটা হাসি দিল। বাথরুমের ভেতর থেকে হাসির শব্দ বিকট শোনাল। কামালকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করল মুহূর্তেই। আমি হাসিমুখে ওকে জানালাম, ‘ঠিক আছে দোস্ত। কোন সমস্যা নাই। যেদিন খুশি দিয়ে আসিস আর এক কাপ চা খেয়ে আসিস।’ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম সে চায়ে দুই চামচ বিষ মিশিয়ে দিব নিশ্চিত! ধীর পায়ে বাড়ি ফিরছি। নিরুর কথা ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেচারি কত আশা নিয়ে বসে আছে আজ সে কয়েকটা ভালো ছবি তুলবে। শাড়ি কিনবার দিন ও বলেছিল বসন্তের প্রথম দিন কানে এক জোড়া ঝুমকা পড়বে। সেখানে ফোকাস করে আমি যেন কয়েকটা ছবি তুলে দেই। অথচ ছবি তুলবার কোন উপায় নেই আজ! আমি দুরুদুরু বুকে বাসায় ঢুকলাম। আজ আমার কপালে শনি আছে! নিরু আমাকে আস্ত গিলে ফেলবে। ছোটবেলায় হুজুরের কাছে যত দোয়া শিখেছিলাম, পড়তে থাকলাম।

বাসায় ঢুকে দেখি নিরুর মুখ হাসি হাসি। আমাকে দেখেই চট করে বলল, ‘পাঞ্জাবিটা গায়ে দাও তাড়াতাড়ি। দেরি হচ্ছে তো।’ আমি অপরাধীর মত মুখ এতোটুকু করে বললাম, ‘নিরু ক্যামেরাটা বাসায় নেই। কামাল নিয়ে গিয়েছে। আজ ও দিতে পারবে না।’ নিরু খুব স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘আমি জানি। সমস্যা নেই বাবু। চল বের হওয়া যাক।’ আমার ভেতর থেকে আশঙ্কার মেঘ কেটে গেল। জগতের রহস্যগুলো মাঝে মাঝে মিলাতে পারি না! কিন্তু নিরুর জন্য মনটা আরেকটু খারাপ হয়ে গেল। বেচারা সব আশা ফেলে দিয়ে পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে। নিরুটা এরকমই। অনেক রাগ দেখায়। কিন্তু ভেতরে ও যে মোমের পুতুল! আমি যে নিরুকে পেয়েছি, এটা আমার জনম ভাগ্য। আমার তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল, ‘নিরুবাবু, তোমাকে এত্তোগুলা ভালোবাসি।’ বলা হল না। পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ও-সহ বের হলাম।

রিক্সা ঠিক করতে হবে। নিরুর সাথে বের হলে অবশ্য নিরুই রিক্সা ঠিক করে। আমার নাকি দূরত্ব এবং রিক্সা ভাড়া সম্পর্কে জ্ঞান একটু কম। তাই নিরু সঙ্গে থাকলে সেই এই দিকটা সামলায়। ক্রিসেন্ট রোড থেকে টিএসসি পর্যন্ত চল্লিশ টাকা ভাড়া করে আমরা রিক্সায় উঠলাম। রিক্সায় উঠলেই আমার গান গাইতে ইচ্ছে করে আর ভীষণ ভাবুক হয়ে যাই। আমার লেখক মনে আসতে শুরু করে কবির কবিতার ছত্র। আজও গান ধরলাম, ‘চাতক প্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছি কালো শশী হব বলে চরণ-দাসী, ও তা হয় না কপাল-গুণে…’ নিরু দাঁত চিপে বলল, ‘আর গান নাই দুনিয়ায়? জানো না আমি এই গানটা পছন্দ করি না?’ আমি বললাম, ‘কত কিছুই আমাদের অজানা তাই না নিরু। তাই বলে রইব কি মোরা ভীরু?’ নিরু চিমটি কেটে দিল আমাকে। এই বিষয়টি আমি উপভোগ করি। নিরু হেসে দিল। ওর হাসিমাখা মুখটা আমার এতো ভালো লাগে! আমাদের হাসির শব্দে কি না জানি না, রিক্সাচালক মহোদয় একটু পেছনে ফিরে ফিক করে হেসে দিলেন! রিক্সাচালকের হাসি দেখে আমার হঠাত মনে হল জগতের সমস্ত সুখ যেন এই মানুষটির চেহারায় ফুটে উঠেছে। অন্যের আনন্দে যে আনন্দিত হতে পারে, তার চেয়ে সুখি আর কে আছে বলুন? এদের জন্যই বাংলাদেশ মনে হয় সুখি দেশের তালিকার উপরে থাকে সবসময়! তাহলে তো সবচেয়ে সুখি শহর ঢাকা! ঢাকায় যে মানুষের চেয়ে রিক্সা আর রিক্সাচালকের সংখ্যা বেশি!

সে যাক। হাস্যোজ্জল চেহারার তিনজন মানুষের ত্রিচক্রযান টিএসসির দিকে যেতে থাকল। সেদিন টিএসসিতে গিয়ে আড্ডা মেরে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলাম দুজন। তারপরদিন ছিল অফিস। ঈদের আগের শেষ কর্মদিবস!

আমাদের পথচলা আমাদের পথে (পর্ব ৩)

This article has 2 comments

  1. eeejlcom Reply

    Hey, have you guys checked out eeejlcom? It’s got a decent vibe and some interesting games you might dig. Give it a look-see when you have a chance. eeejlcom

Leave a Reply to plus777casino Cancel reply