অথবা মহিলা কিংবা মেয়ে নতুবা নারী
আজ মা দিবস। মাকে নিয়ে লিখে, বলে, আবেগ প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। আমার কাছের ভাই-বোন-বন্ধুরা চমৎকার স্মৃতিময় নানান গল্প-ঘটনা লিখেছেন মাকে নিয়ে। আমি অনেক আনন্দ নিয়ে সেগুলো পড়ছি। অনেকেই যেহেতু মাকে নিয়ে গল্প বলেছেন আমি একটু পাশ দিয়ে গিয়ে মা-মেয়ে-মহিলা-নারিদের নিয়ে কিছু গল্প করি।
আজ সন্ধ্যায় কুড়িল বিশ্বরোড থেকে একটা বিআরটিসি বাসে উঠলাম; গুলশান অভিমুখে যাত্রা। ডাবল ডেকার তাই পেছনেও মহিলারা বসেন, সামনের একটা অংশেও বসেন। যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে একজন মহিলা উঠে তাদের সিটে বসতে চাইলেন একজন সিট দখলকরা লোকের কাছে। হুট করে সামনে দাড়িয়ে থাকা একজন বলে বসলেন, মেয়েদেরও কস্ট করা উচিৎ, আমরা তাদের মায়ের চোখে দেখে বসতে দিব, তারা কি আমাদের বাবার চোখে দেখে সিট ছেড়ে বসতে দিয়েছে কখনও? তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন আছে, আমাদের আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি…
লোকটার এহেন উন্নাসিক মানসিকতা দেখে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আরও কস্টের বিষয় হল, মোটামুটি ঘণ্টাখানেকের মত মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে এরকম বাক-বিতন্ডা চলছিলই। এক পর্যায়ে একজন মহিলা আক্ষেপ বলেই বসলেন, মেয়েদের জন্য সরকার সব রুটে আলাদা বাস দেয় না কেন! মা দিবসে একজন মায়ের, অথবা হোক না একজন বোনের এরকম আক্ষেপ শুনতে কেমন লাগে বলুন? আসলে তর্ক করার জন্য লোকটাকে অনেকগুলো যুক্তি দেখানো যেত, কিন্তু যে ব্যক্তি সমগ্র মেয়ে জাতিটাকেই শত্রু ভেবে বসে আছে, তাকে বোঝানো অসম্ভব।
ঘটনাটা সামান্য হতে পারে, কিন্তু এরকম অজস্র সামান্য নেতিবাচক ঘটনা আমাদের দেশের মেয়েদের মনে অনেক অশুভ প্রভাব ফেলে। এমনকি মেয়েদের দুর্বলতার কথা বারবার অস্বীকৃতিপূর্ণ উপায়ে উপস্থাপনের ফলে তাদের শরীরেও অনেক ক্ষতিকর প্রভাব পরে। এভাবে একটা জাতির অর্ধেক মানবসম্পদকে আমরা নানাভাবে কুরুচিপূর্ণ ব্যবহার দিতে থাকলে বিশ্বাস করুন একসময় তাদের যাবতীয় কর্মক্ষমতা লোপ পাবে। আমি প্রতিদিনই, আমি কেন আমরা সবাই, আপনিও, প্রতিদিনই মেয়েদের উপর অত্যাচার, অথবা বিভিন্ন উপায়ে অপব্যবহার কিংবা সমাজের পৃথক পৃথক শ্রেণির মানুষের কাছে লাঞ্ছনা বা হেনস্থার স্বীকারের খবর দেখতে পাই।
খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবুন তো, আমাদের দেশের মেয়েদের সাথে এরকম যদি চলতেই থাকে একটা পর্যায়ে এসে গোটা নারি জাতিটা কিরকম একটা পরিস্থিতির মুখে পড়বে? আপনার বোন যদি তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা বাজে ঘটনার জন্য মানসিকভাবে বিকারগ্র্রস্ত হয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়, আপনি কি সারাদিন খুব আমুদে মেজাজে চলতে পারবেন? পারবেন আপনার মেয়েকে একটা বাসের মধ্যে দাড়িয়ে থেকে একশ’ লোকের বাজে মন্তব্য হজম করতে দেখেতে?
না, আপনি পারবেন না। আমিও পারিনি। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে উঠে গিয়ে ঐ ভদ্রমহিলাকে বসতে দিয়েছিলাম। আর মন্তব্য করা লোকটার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়েছিলাম। এটাই আমার প্রতিবাদ।
আমার কোন পাঠক বন্ধু যদি দয়া করে লেখাটা এতোদূর পড়ে এসেছেন, আপনার কাছে, হ্যাঁ আপনার কাছেই আমার অনুরোধ, আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়েদের বিভিন্ন বয়সে নানান কারণে অপদস্থ করা হয়। আজ মা দিবস। আপনার মাও একজন মহিলা; একজন নারি; একজন মেয়ে। তার মুখের কথা স্মরণ করে আসুন প্রতিজ্ঞা করি, আমার দ্বারা কখনও কোন মেয়ে কোন বাজে মন্তব্যের স্বীকার হবেন না। কোন মেয়ে কখনও আমার দ্বারা লাঞ্চিত হবেন না। রাস্তায় প্রতিটি শ্রেণিপেশার নারিকে সমান সম্মান দিবার চেষ্টা করব। বাসে আমার আসনটা ছেড়ে দিব কোন মেয়েকে অথবা হোক না একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে কস্ট করে দাড়িয়ে থাকলে দেখলে। কি হবে একটু দাড়িয়ে কস্ট করে গেলে? কিন্তু, ঐ মানুষটার মুখে যে হাসিটা আপনি ফোটালেন সেটাতো কখনও কিনতেও পারবেন না। আর খুব ক্ষুদ্র করে হলেও সমাজে একটা ভালো দিক তো তুলে ধরলেন। তাই না?
আমরা এরকম ছোট ছোট নেতিবাচক দিকগুলো এড়িয়ে শুভ কাজগুলো করি আসুন। আসুন না প্লিজ।