আসমানের সীমানা পেরিয়ে আজ ভূমি থেকে শত সহস্র মাইল দূরে চলে যাচ্ছি। অনেক উপরে; অনেএএএএএক বেশি উপরে। সূর্যের কাছে দিয়ে দূরের কোন নাম না জানা ছায়াপথের দিকে। ধুলি ঝড়ে উথাল-পাথাল মঙ্গলের পাশে দিয়ে যাবার সময় যেন বড় কিছু ধুলোর কণা চোখে লেগে গেল। কেমন ঝাপসা লাগছে সব। তীব্র আর ঝাপসা। ছায়াপথ নয়, আমার অভিযান সম্ভবত কালপুরুষ নীহারিকার দিকে। ওই দূরের চোখে নেশা ধরানো আলোক ঝলমল কালপুরুষ যেন দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতি আর শনির বলয় ছুঁয়ে যাচ্ছি মাত্র। এ যেন এক অনাবিল শান্তির যাত্রা। পথে কোন পাহাড় নেই, উঁচুনিচু বন্ধুর পথ নেই। নেই জনমানবের হাতছানি। নেই রাস্তার সেই পুরাতন জঞ্জাল, সেই গাড়ির ভেঁপু, সেই চিৎকার চেঁচামেচি। সব কিছু কেমন শান্ত; কেমন নিবিড় স্নিগ্ধ। মনে হচ্ছে এই যাত্রার শেষ না হোক। কি হবে এভাবেই এই গ্যালাক্সি ওই গ্যালাক্সি ঘুরে ঘুরে বেড়ালে? কি-ই হবে? আমি কি সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ? আমি কি মাননীয় গণনীয় কেউ? আমি কি মন্ত্রী-এমপি? নাহ!

আমি ভীষণ সাধারণ একজন মানুষ। একেবারেই সাধারণ। কোন কাজে-কর্মে ব্যস্ত আমি নই। না কোন দেশ-সংস্কারের কাজে, না কোন দেশ-দ্রোহী কাজে। আমি তো আমাকে নিয়েই আছি। এই আমিই তো সেদিন সংসদ ভবনের সামনে চানাচুর খেতে খেতে ভাবলাম, কিছু একটা হয়ে যাব। দেশের কিছু একটা করে এই আমিই খ্যাতি পকেটে নিয়ে ঘুরব ফিরব। এই না সেদিন বন্যা আমাকে বলল, আমাকে দিয়ে নাকি হবে। ওমা! কি ভীষণ সাদাসিধে কথা। বলেই বসল, আমি নাকি রাজা-টাজা বনে যাব! আমার নাকি চেহারায় খুব ভালো কিছু লেখা আছে! কি জানি, কে জানে বন্যা হয়তো হাত নয় মানুষের মুখও দেখতে পারে। এইতো সেদিনই আমার ইয়া বিশাল দাড়িগোফ দেখে মুহিত বলে বসল, আমি নাকি ঋষি-মনি। আমার দ্বারাই নাকি হবে। ভাবলাম বলি, কি হবে রে? কি হবে টা কি? পড়ে ভাবলাম, থাক। এটাই বা যে বলল, এও কম কি!

আমার চশমা পড়া রোদে হাটা চেহারা দেখে মামা বলতেন, তুই খুব সাহসী ছেলে। তুই তো পারবি। সেদিনও মামাকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি, কি পারব মামা?

সারাদিন কারণ ছাড়া হেঁটে হেঁটে আমার স্যান্ডেল জোড়া গেল। এলিফ্যান্ট রোডে জুতা কিনতে গেলাম। দোকানি আমাকে জুতা দেখাবার সময় বলল, আফনের পায়ের সাইজের জুত আছে। আফনার কফাল ফিরবই! এটা কোন ‘বিজনেস স্ট্র্যাটেজি’ ছিল নাকি সত্যি আমার পায়ের ‘জুত’ আছে জানি না! জানতে ইচ্ছেও করে না। সত্যি কথা বলতে ইদানিং কিছুই জানতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় শুধু সুদূর পথে পাড়ি দিব কবে। তাই তো আজই দিলাম আসমানের পথে যাত্রা। ওইতো ইউরেনাসের ধূসর আর নীল রঙের মাইক্রোমিটার বলয়গুলো দেখতে পাচ্ছি! তীব্র ঘোরের মাঝে এতো স্পস্ট কীভাবে দেখছি সেটাও রহস্য!

স্নিগ্ধ বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে মাঝে মাঝেই রাতের অসীম অন্ধকারের বুকে তীব্র আলো খুঁজতে বেড়িয়ে পরতাম। সাথে থাকতো জাভা ফোনটার ‘সাইডার-এলিস‘। বন্যা খুব বলতো, এতো রাতে যে মাতালের মত ঘুরে ঘুরে বেড়াও পুলিশ ধরবে তো। আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম। বলতাম, দেখো আমি সস্তা চেহারার একজন মানুষ। আমাকে ধরার প্রশ্নই ওঠে না। আমার চেহারায় চোর, ডাকাত কিংবা গেঁজেলের কোন চিহ্ন আছে কি? ও বলতো, তা নেই, কিন্তু এই রাত বিরাতের হেঁটে চলা আমার একদম অপছন্দ। আমি ভদ্র ছেলের মত বলতাম, আর রাতে ঘুরে বেড়াব না। কিন্তু ঠিক সেদিন রাতেই আমাকে শাহবাগ মোরে কিংবা পরীবাগের দিকে কোন চায়ের দোকানে পাওয়া যেত। এই নিয়ম ভাঙার অনিয়মও ছিল আমার প্রাত্যহিক-দিব্যরজনীর এক অদম্য কাব্য! প্রতিটা মুহুর্ত আমার কেমন যেমন অমূল্য মনে হত। কেমন যেন ব্যস্ততা। কিন্তু কিসের ব্যস্ততা? আমি তো সারাদিন খেই হারিয়ে ফেলা গাড়ি চালকের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। এ যেন গা বাঁচিয়ে চলা। অবাক হই, কোন্ জিনিস বা বিষয় থেকে গা বাঁচিয়ে চলতাম আমি? এরকম কত সহস্র অজানা না-জানা প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কি হবে এসবের উত্তর পেয়ে?

আরেকটা কাজ পারতাম খুব। দুঃখ লুকোতে। একদম গায়েব করে দিতে পারতাম সব কষ্টগুলোকে। বন্যা কখনও আমার টাকা পয়সার টানাপোড়েন বা অন্যান্য দুর্দশার কথা টেরও পেত না। কেমন যেন লজ্জা লাগতো। ও কি ভেবে বসে না জানি! এমনকি কাউকেই বলতে পারতাম না। না, মুহিতকেও না। ও অবশ্য আমার পকেটের খবর টের পেত। ছেলে মানুষ তো। ছেলেদের এসব ব্যাপার বুঝতে পারাই স্বাভাবিক। তখন বলতো, কিরে যাবি নাকি সিনেপ্লেক্স এ? আমি এমন ভাব করতাম, যেন শুনতে পাই নি। তবে মুহিত অনেক সময় টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে এটা মনে আছে। অদ্ভুত কোন কারনে কখনও ও আমার কাছে সে টাকাগুলো চাইতো না। আমিও বেমালুম ভুলে যেতাম; অথবা ভুলে যাবার ভান করতাম। সময়ের স্রোতে ভুলেই যেতাম সত্যিকার অর্থে। এখন ঠিক করে বলতে পারব না ও কতবার আমাকে টাকা দিয়েছে বা কতই দিয়েছে! যাক সে কথা। মধ্যবিত্তের কথ্যে-গল্পে কেমন করে যেন অর্থনৈতিক বিষয়টা চলে আসে! তবে এখন আমি মধ্যবিত্ত নই। এই সুদূর পথের যাত্রীদের আলাদা কোন ‘ইকনোমিক স্ট্যাটাস’ নেই।

আমার শত মিথ্যে ব্যস্ততার অন্যতম সাক্ষী আমার পুরনো গিটারটা। জং ধরা তারের রঙচটা এই গিটারটাই ছিল আমার প্রতি রাতের নীরব নিথর স্তব্ধতা তাড়ানোর একমাত্র বাদ্য। তখন নটরডেমে ফার্স্ট ইয়ারে, স্কলারশিপের সমস্ত টাকাগুলো দিয়ে বহু প্রতীক্ষিত এ বস্তু কিনেছিলাম সাইন্স ল্যাবরেটরি থেকে। সাইন্সের তুমুল পড়ালেখার মাঝেও এই জিনিস যেন একটা প্রসন্নতা এনে দিত। কালের খেয়ায় ধীরে ধীরে তারগুলো পুরনো হতে লাগল। আবির অনেকবার বলেছিল, কি ভাই একটা নতুন গিটার কিনার টাকা হয় না? কত নিত্য নতুন গালিও দিত গিটারটাকে! তবে ও নিজেও মাঝে মধ্যে তার বদলে দিত গিটারটার। আওয়াজের তাতে কিঞ্চিত উন্নতি হলেও সামগ্রিক অর্থে কোন কিছুই হত না। তবে ওই দিয়েই কত শত গান গেয়েছি। বেদনার কথাগুলো মনে হয় ওই গিটারটার উপর দিয়েই গেছে। কত পরিকল্পনা ছিল, ইলেক্ট্রিক গিটারটা কিনেই ফেলব। সাথে অ্যাম্প আর প্রসেসর। শফিক ভাইকে বলে রেখেছিলাম, উনার কোন এক বন্ধু নাকি এসবের ভালো খবর দিতে পারে। কত স্বপ্ন দেখতাম দাড়িয়ে ইলেক্ট্রিক গিটার প্র্যাকটিস করছি। আবিরও স্বপ্নগুলোর সাথে জুড়ে দিত নানান পাখনা। এটা সেটা কত কি! আর এই আমিই কি না আজ সব ছেড়েছুড়ে দিলাম আসমানের পথে যাত্রা। যাত্রা পথে মাঝে মাঝেই হুট করে তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ তাতিয়ে যাচ্ছে।

আমার আকাশ জুড়ে যে স্বপ্নগুলো খেলা করতো, তার বেশিরভাগটা জুড়েই ছিল বন্যা। ওকে একবার বলেছিলাম, হুট করে যদি মরে যাই কি করবে তুমি? অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, আরেকজন জুটিয়ে নিব। কয়েক সেকেন্ড পর ওপাশ ফিরে সে কি ডুকরে ডুকরে কান্না! আর কোনদিন এই জাতীয় ঠাট্টা করিনি বন্যার সাথে। কত শত পাগলামো করতাম। বৃষ্টি হলেই ওর হলের সামনে গিয়ে বসে থাকতাম আর জ্বর বাঁধিয়ে ফেলতাম। এমনও হয়েছে মাঝে মাঝে ও টেরও পেতো না যে আমি ওর হলের সামনে গিয়ে বসে আছি! কি দুর্দান্ত সে সময়গুলো! আর সেগুলো ছেড়েছুড়ে চলে যাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে বন্যাকে যদি বলে যেতাম ভালো হত। কিন্তু এই যাত্রা তো হুট করেই শুরু হল। সবে সৌরজগত পার হলাম বোধ হচ্ছে।

আমার বাবা, ফজলুল করিম। একজন স্কুল শিক্ষক। সাদামাটা একজন মানুষ। গত ঈদে বাড়ি যাবার সময় কি মনে করে বেলমন্টে থেকে বাবার জন্য শার্ট আর প্যান্টের পিস নিয়ে নিলাম। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল। তবুও নিলাম। কেমন জানি একটা শান্তি লাগছিল। বাড়ি পৌঁছেই বাবার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কই বাবা কই? দেখা গেল তিনি বাড়িতে নেই। সন্ধায় আসলেন; ক্লান্ত চেহারা। বাবার হাতে ব্যাগটা তুলে দিলাম। আমার অতি সাধারণ শিক্ষক বাবা ধমকের সুরে বললেন, কি দরকার ছিল এসবের? পরক্ষণেই ব্যাগটা রেখে অন্য দিকে ঘুরে প্রস্থান করলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান কর্তা চোখের জল দেখিয়ে সবাইকে লজ্জায় ফেলতে চাননি। আমি দুর্দান্ত আনন্দ পেয়েছিলাম! এই অনুভূতিগুলো বোতলবন্দি করে রাখা গেলে খুব ভালো হত। বাবা কি জানেন আমার এই যাত্রার কথা? জেনে যাবেন হয়তো এরই মাঝে।

শেষের আগেঃ

সেদিন ডিপার্টমেন্টের ইমতিয়াজ ভাই বললেন, তাঁদের ব্যাচের বিদায় উপলক্ষে একটি সুভ্যেনির বের করবেন। আমাকে লিখতে হবে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আজ তো লেখা জমা দিবার শেষ দিন! লিখতে বসে দেখলাম কলম-কাগজ কিছুই নেই। শার্টটা গায়ে দিয়ে বের হলাম লেখার জোগাড় যন্ত্র খুঁজতে। শুক্রবার ছিল; আশেপাশে কিছুই পেলাম না। নেহায়েত গ্রিন রোড থেকে মিরপুর রোডের দিকে গেলাম। বুঝলাম, নীলক্ষেত যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। উনিশ নম্বর বিকল্প গাড়িটা ছুটে আসছিল হাতের ডান দিক থেকে। ভাবলাম, উঠে পড়ি। উঠেই পড়েছিলাম। বাকিটা আর মনে নেই। এখন শুধু টের পাচ্ছি, ভাসছি আমি। আকাশের সীমানা পেরিয়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। অনেক উপরে; অনেএএএএএক বেশি উপরে। সূর্যের কাছে দিয়ে দূরের কোন নাম জানা ছায়াপথের দিকে। এ যেন এক অনাবিল শান্তির যাত্রা।

কিন্তু ইমতিয়াজ ভাইকে যে কথা দিয়েছি আমি সুভ্যেনিরে গল্প লিখব। এমনকি গল্পের নামও তো ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি, ‘আসমানের সীমানা পেরিয়ে’। তবে কি আমার গল্পটা লেখা হল না? মুখরিত ঘরে সবার মাঝে বসে আমার পুরাতন গিটারটা কি তবে আর বেজে উঠবে না? ফজলুল করিম মাস্টার কি আমার বাড়ি যাবার পথে আর অপেক্ষা করবেন না? আর বন্যা? বৃষ্টির দিনে ও কি করবে? জানালা দিয়ে দেখবে না, আমি ওর হলের সামনে বসে আছি কি না? এরকম কত সহস্র অজানা না-জানা প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কি হবে এসবের উত্তর পেয়ে? আমার যাত্রা যে আসমানের সীমানা পেরিয়ে…

This article has 2 comments

  1. 9nbetcom Reply

    9nbetcom, huh? Took it for a spin. Honestly, it’s pretty smooth. Good selection and easy to use! Seems solid. Play responsibly though, yeah? 9nbetcom

  2. 7ggg Reply

    Alright, just checked out 7ggg and it’s… well, it is what it is. Not my usual go-to, but hey, different strokes for different folks! Check it out if you’re curious: 7ggg

Leave a Reply to 7ggg Cancel reply