গল্প-০১

আশি বছর বয়সী মুহম্মদ শাহজাহান মিয়ার বকরির বাচ্চা হয়েছে। এই আনন্দ সংবাদ বাবাকে দেবার জন্য তার ছোট মেয়ে হালিমা বুশরি মোবাইল ফোনের দোকানে এসেছে। তার বাবা ঢাকায় থাকে। রিক্সা চালায় সেখানে। সাথে তার বড় ছেলে রাসেল আর তার বউ-বাচ্চাও থাকে। মাস শেষে শাহজাহান মিয়া ছয় থেকে সাতশ টাকার বাজার করে দেন ছেলের বউকে। তাতেই তারা খুশি। বাকি টাকা শাহজাহান মিয়া গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এমাসে তিনি তার বউকে সাড়ে চার হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। মেয়ের ছেলে হয়েছে গত মাসে। সে বাবার বাড়িতে মেহমান এসেছে। ওদিকে আবার শাহজাহান মিয়ার শাশুড়ি জমিরন বিবি তার মেয়ের কাছেই থাকেন। তাই সংসারে অনেক খরচ। বকরির বাচ্চার কথা শুনে খুশি হল শাহজাহান মিয়া। কিন্তু এই বকরির পেছনেও খরচ আছে। প্রতিদিন চল্লিশ টাকার চালের ভুসি খায় বকরিটা।

আজ রিক্সা চালিয়ে তিনি মতিঝিল চলে এসেছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামবে বলে। নটরডেম কলেজের দ্বিতীয় গেটের ওখানটায় রাস্তার পাশেই কম খরচে ভাত ডাল পাওয়া যায়। শাহজাহান মিয়া খেতে শুরু করলেন। তার রিক্সার পেছনেই একটা লাল গাড়ি এসে থামল। তিনি দেখতে পেলেন তার ছেলে রাসেল। সে এই গাড়ির ড্রাইভার। স্যারকে এক জায়গা থেকে অফিসে দিয়ে সে এখানে এসে থেমেছে। বাবাকে দেখে সে খুশি হয়ে গেল। দুই বাপব্যাটা মিলে রাস্তার ধারে বসে সানন্দে ভাত ডাল দিয়ে পেট ভরালো। খাওয়া শেষে ছেলেই জোর করে বিলটা দিয়ে দিল। আনন্দে ভরে গেল শাহজাহান মিয়ার মন।

কি সুন্দর! কি সুন্দর!

এই শাহজাহান মিয়ার বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। তিনি স্বাধীনতার আগেই ঢাকায় আসেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় কয়লার মিলে কাজ করে। তার এক সহকর্মীর নাম নারায়ণ। পরবর্তীতে তিনি ঠেলাগাড়ি চালানো শুরু করলেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে শেষমেশ রিক্সা চালান এখন।

আজ তার মোট আয় হয়েছে তিনশ পঞ্চান্ন টাকা। একশ টাকা জমা দিলে হাতে থাকে দুইশ পঞ্চান্ন টাকা। নাতির জন্য তাই তিনি আজ চানাচুরের প্যাকেট কিনেছেন তিনটি।

গল্প-০২

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ সময়। নভেম্বর মাস। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে দিনাজপুরের খানশামায়। ডাঃ আব্দুল আলী খুব ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করেন। তিনি শুনেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের ধরে ধরে আলবদর-রাজাকারেরা নিয়ে যাচ্ছে আর অকথ্য নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করছে। তার বন্ধু ডাঃ মোসাব্বের আহমেদকে এপ্রিলের দিকে আলবদরেরা ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে তাঁর ভয় আরও বেড়ে গেছে। তাঁর ভাই মুন্সি হাজিরুদ্দিনের সহায়তায় তিনি চলফেরা করেন। মুন্সি সাহেবের বেশভূষা দেখেই সম্ভবত পাকবাহিনী বা আলবদর-রাজাকারেরা কিছু বলে না। তিনি ভাইকে নিয়ে এলাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের নেকমরদ ইউনিয়নে চলে গেলেন। এই আসাটাও অনেক বিপদজনক ছিল। গরুরগাড়ি নিয়ে গড়েয়া হয়ে শিবগঞ্জ দিয়ে তারপর এসেছেন নিজ গ্রাম ভবানীপুরে। এলাকার লোকজন এই গ্রামকে ডাকে দেহুনি বলে।

ডাঃ আব্দুল আলীর শেষমেশ কিছুই হয়নি। স্বাধীনতার পরেও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন। নেকমরদ ও রানিশঙ্কইল উপজেলা হাসপাতালে তিনি অনেকদিন কর্মরত ছিলেন। ২০০৫ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

গল্প-০৩

ফাহিমা খাতুনের বয়স আনুমানিক সত্তর হবে। তিনি একটা চায়ের দোকান চালান। তাঁর স্বামী হেলাল শিকদার মারা গেছেন বহুদিন হল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফাহিমা খাতুনের বয়স ছিল পঁচিশ-ত্রিশ। সাদা শাড়ি পড়ে তিনি নিজের বয়স বাড়ানোর চেষ্টা করে চলাফেরা করতেন। তিনি আব্দুল গনি নামে এক রাজাকারের বাড়িতে কাজ করতেন। তাই একটু নিরাপত্তা ছিল। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যাবেলা তাঁকে বাড়ির কাজের ছেলে হেলাল তাঁর মায়ের কাছে দিয়ে আসত। গরিব ফাহিমা খাতুন একটা কাজ করতেন প্রায় প্রতিদিন। আব্দুল গনির বাড়ি থেকে কিছু চাল চুরি করে আনতেন শাড়ির আঁচলের নিচে। সেই চাল দিয়ে গভীর রাতে ভাত রান্না করে রাখতেন ফাহিমা। দূরসম্পর্কের চাচতো ভাই হাশেম আর কাশেম লুকিয়ে খেতে আসত বোনের কাছে। এই দুই হাশেম আর কাশেম যে মুক্তিযোদ্ধা তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না!

শেষকথাঃ

#আজ মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়ার সাথে আমার দোয়েল চত্বরের পাশেই দেখা হল। তাঁর সাথেই আজিমপুর পর্যন্ত গেলাম। রিক্সা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, “চাচা, যুদ্ধের সময় কই ছিলেন? মানে কি করসিলেন?” তিনি আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকালেন, তাতে আর উত্তরের দরকার ছিল না। শাহজাহান মিয়ার বন্ধু নারায়ণ তাঁর সামনেই পাকবাহিনীর গুলি খেয়ে মারা যান এই তথ্যটুকু তিনি আমাকে দিলেন।

     # ডাঃ আব্দুল আলী আমার দাদু। তিনি মৃত্যুর ভয়ে নিরাপদে থাকতে চেয়েছিলেন ভালো কথা। কিন্তু দাদুর গল্প এখানেই শেষ হয়ে গেলে আমার খুব খারাপ লাগতো। তিনি ঐ দুঃসময়টায় কিছুই করতে পারেননি ভেবে কষ্ট পেতাম। না গল্প এখানেই শেষ হয়নি। দাদু সরকারি ডাক্তার ছিলেন। তাই প্রতি মাসে গুড়োদুধের বস্তা পেতেন একটা করে(অনেকটা রেশনের মত)।  সেই দুধের কয়েকটা বস্তা খানশামার বাড়িতে ছিল। দাদু সেখানে কর্মরত ছিলেন ঐ সময়। দাদি সেই গুড়োদুধ গ্রামের সবাইকে বিলিয়ে দিতেন গোপনে। এবং তার একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া হত নিয়ম করে।

     #ফাহিমা খাতুনের গল্প আমার এক বন্ধুর কাছে শোনা।

This article has 2 comments

  1. new88online Reply

    New88online is a decent option if you’re searching for a new platform. The site layout could be better, but it’s functional. They seem to have competitive odds on most sports and some unique betting options as well. Take your chance on new88online

মন্তব্য করুন