সন্ধ্যা সাতটা। বাস থেকে নামলাম। আহ! অনেকদিন পর গ্রামের বাড়ি এলাম। আমাকে নিবার জন্য কাদের ভাই এসেছেন। কাদের ভাই ভ্যান চালান। তবে শুধু দিনে। রাতকানা রোগের কারণে রাতে চালাতে পারেন না। আজ তার একটু অসুবিধাই হবে বৈকি। সেটা নিয়ে কাদের ভাইয়ের মাথা ব্যাথা নেই। আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “আলা অসলো ভাই? এতো সান হইল ক্যানে? ভ্যানত উঠ চ যাই।” আমি বললাম, “চল কাদের ভাই।”

আমাদের গ্রামের নাম ভবানীপুর। রানী ভবানীর নামে নাম। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত নাম দেহনি। লোকে উচ্চারণ করে দেহুনি। এই নাম কোত্থেকে কীভাবে এলো জানি না। গ্রামে ঢুকতেই চামার দীঘি। তারপর ভবানীপুর মাদ্রাসা। আমাদের দাদাদের হাতে গড়া। গ্রামবাসীদের অর্থে চলে। প্রতিবছর এখান থেকে তিন জন করে হাফেজ বের হয়। মাদ্রাসা সংলগ্ন আমাদের পারিবারিক গোরস্তান। কাদের ভাইকে থামাতে বললাম। তাকে ব্যাগপত্র নিয়ে পাঠিয়ে দিলাম বাসায়। বললাম, “আমি আসছি তুমি যাও কাদের ভাই।” কাদের ভাই ভ্যান নিয়ে চলে গেলেন।

দাদুর কবরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাঁশের বেড়া দেওয়া চারপাশে। কবরের ভিতরে জংলী ছোট ছোট গাছ জন্মেছে। অন্ধকার বলে কিছুই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। মাদ্রাসার ক্ষীণ আলোয় আবছা আবছা দেখাচ্ছে। কোরান পাঠের রিনরিনে মৃদু সুর আসছে মাদ্রাসা থেকে। যেন কোরাস করে পাঠ করা হচ্ছে।

কবর জিয়ারত শুরু করলাম। হঠাত বুঝতে পারলাম আমার পাশে আরেকজন হাত তুলে দাঁড়িয়েছে। ছফি পাগলা। ছফি প্রায় বিশ বছর যাবত এই এলাকায় আছে। কোথায় তার দেশ কেউ জানে না। বেশভুষা বেশ পরিষ্কার। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় ঘনচুল। দেখতে অনেকটা ঋষিমুনিদের মত। আমার জিয়ারত শেষ হল। সেও এমন ভঙ্গি করল যেন তারও শেষ হয়েছে। প্রায় তিন মাস পর ছফিকে দেখলাম। ওর চোখ দুটোতে কি যেন আছে। জ্বলজ্বল করে সবসময়। এটাই সম্ভবত মায়া!

আমাকে দেখে বলল, টাকা দে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। আমার ধারণা, গ্রামের যাদের সে পছন্দ করে তাদের কাছেই শুধু টাকা চায়। দুপুরবেলা এর ওর বাড়িতে খেয়ে নেয়। ছফিকে একটা দুই টাকার নোট দেওয়া মাত্র উধাও হয়ে গেল। দেখা যাবে। সামনের ‘ঘুন্টিতে’ বসে সে চা আর বিস্কুট খাচ্ছে। বাসায় ফিরলাম। অনেক ক্লান্ত। এক ঘুমে রাত কাবার। পরদিন সকালে দেখি ছফি খালি গায়ে আমাদের উঠোনে বসে আছে। মা থালাতে করে মুড়ি আর পাটালি গুড় দিয়েছেন এক টুকরা।

আমাকে দেখেই ছফি বলল, “নদীত অনেক মাছ ছ্যা”। পাগল মানুষ কি থেকে কি বলে। নদীতে মাছ থাকবেই; জানা কথা। ছফির কথার মর্মার্থ বুঝলাম সপ্তাহখানিক পরে।

বাড়িতে আসলেই আমি আর ছোট চাচা রাতে কুলিক নদীতে মাছ ধরতে যাই। যা পাই তাই নিয়ে আসি। বড় জালে কি একটা সমস্যা ছিল বলে দুইজন দুইটা বিশাল ছিপ নিয়ে নদীর পাড়ে গেলাম সে রাতে। পূর্ণিমার রাত। চাঁদের রহস্যময় আলো নদীর পানিতে পড়ে চিকচিক করছে। প্রায় এক ঘন্টা অধ্যবসায়ের পর আমরা একটা মাঝারি সাইজের মাছ পেলাম। আচমকা দেখি কোত্থেকে একটা ছেড়া জাল নিয়ে ছফি পাগলা এসে নদীতে নামল। বার দুই মাত্র জাল ফেলে আনুমানিক দুই আড়াই কেজি ছোট মাছ ধরে ফেলল! আমি আর ছোট চাচা চেয়ে রইলাম। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মাছগুলো সে আবার পানিতে ছেড়েও দিল। আমাদের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, নদীত অনেক মাছ ছ্যা। আমরা রহস্য বুঝতে পারলাম না।

সেবার ছুটি শেষ করে ঢাকায় ফিরলাম। এর মাঝে অনেকবার বাড়িতে গিয়েছি ঈদের ছুটিগুলোতে। ছফি পাগলার কথা ভুলে গেছি ইতোমধ্যে।

প্রায় দেড় বছর আগের ঘটনা। ভার্সিটিতে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। ক্লাস শুরু হয়নি তখনও। বাড়ি গেলাম ক’দিনের জন্য ছুটি কাটাতে। মাঝে মধ্যে গল্পের বই হাতে নিয়ে কুলিক নদীর পাড় ধরে হেঁটে দুরে কোথাও চলে যাই। নির্জন যায়গা দেখে বসে পড়ি। নদীর শীতল বাতাস গায়ে লাগে। চমৎকার অনুভূতির সৃষ্টি হয় তখন। এমনি একদিন বসে আছি নদীর পূর্ব পাড়ে। হাতে এডমন্ড স্পেন্সারের কবিতার একটি বই। খুব কাছের কেউ একজন এই কবির অন্ধ ভক্ত। জোর করে বলে দিয়েছে কবিতাগুলো যেন পড়ি। আজ শখ হল এই ব্যক্তি কি লিখেছেন তা দেখার। বইটা খুলেছি মাত্র। দেখি পাশে ছফি পাগলা এসে বসল। আমি ওকে না দেখার ভান করে কবিতা আবৃতি করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম। এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছফিও উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বলল, “Unhappy verse, the witness of my unhappy state…”

আমি একটু চমকালাম। পাগল মানুষ এতো চমৎকার ইংরেজি উচ্চারণে এসব কি আবোলতাবোল বলছে! খুব অস্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। তবে ঐ দুটো লাইন মাথায় গেঁথে গেল আমার। সারাক্ষণ বাঁজতে থাকে মাথার ভিতরে। সময়ের ছলনায় এসবও ভুলে গেলাম।

সেদিন কম্পিউটার ল্যাবে বসে অলস দুপুরটা কাটাচ্ছিলাম। গুগলে কি একটা খুঁজছিলাম। হুট করে মাথায় সেই ভাঙা রেকর্ড বেঁজে উঠল, “Unhappy verse, the witness of my unhappy state…”

কি মনে করে লাইনগুলো লিখে দিলাম গুগলে। যা দেখলাম তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এই লাইন দুটো এডমন্ড স্পেন্সারের আরেকটি বইয়ের একটি বিখ্যাত কবিতা Iambicum Trimetrum– এর প্রথম দুই লাইন!

এর পরে এখন পর্যন্ত আর ছফি পাগলাকে দেখিনি। প্রতি ছুটিতে গিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। দেখা পাইনি।

[আগ্রহী পাঠক কবিতাটা পড়ে দেখতে পারেন, Iambicum Trimetrum

গল্পে কাদের ভাই এবং ছফি পাগলার সংলাপে ঠাকুরগাঁওয়ের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছি। ‘সান’ মানে হল সন্ধ্যা, ‘ছ্যা’ মানে হল আছে]

মন্তব্য করুন