কেন নটরডেমে পড়া উচিত
আজ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। পরীক্ষার্থীর আন্তরিক চেষ্টার পরে ফলাফল যত পয়েন্টই হোক না কেন, আমার কাছে সেটাই ভালো ফলাফল। চেষ্টার উপরে তো কিছু নাই। তবে যারা ফাঁকিবাজি করে আর অলসভাবে সময় কাটিয়ে খারাপ ফল করে এখন সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদের জন্য কোন সমবেদনা প্রকাশ করতে পারছি না।
যাই হোক, যেহেতু ফলাফল প্রকাশ হয়েই গেল আর সব কিছু ধীরে ধীরে খুলেও দিবে, তাই ধরে নেওয়া যায় কলেজ ভর্তিরও দেরি নেই। আমি আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাটুকু ভাগ করে সবাইকে জানাতে চাই কেন ছেলেদের নটরডেম কলেজে পড়া উচিত। যেহেতু মেয়েদের পড়বার উপায় নাই আর মেয়েদের জন্য অনেক ভালো ভালো কলেজ আছে, সেসব কলেজের অভিজ্ঞরা হয়তো সে ব্যাপারে জানাতে পারবেন।
ক্যাডেট কলেজে রিটেনে টিকেও যখন মেডিকেলে আউট হয়ে হয়ে গেলাম চোখের সমস্যাজনিত কারণে, আমার ক্যাডেট কলেজ পড়ুয়া অগ্রজ আমাকে চিঠিতে জানাল, সমস্যা নাই তুমি ক্যাডেট কলেজে চান্স পাও নাই তো কি হইসে, নটরডেম কলেজে পড়বা! তখন থেকে মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল, ইজ্জত রাখতে হইলে নটরডেমেই পড়তে হবে।
এখন ইজ্জত রাখার জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক, মহান আল্লাহ্র রহমতে আমি ২০১০ সালে নটরডেম কলেজে পড়ার সুযোগ পাই (অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে)। এবং দুই বছর এ কলেজে পড়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। পড়াশোনার দিকটা বাদ দিয়ে বাকি দিকগুলোও যদি শুধু বিবেচনা করা হয়, নটরডেম কলেজ যে নৈতিক শিক্ষা দেয় তা এই দেশে কেন, পুরো উপমহাদেশে বিরল! আমার নিজের দেখা কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলি।
*** প্রথম গার্ডিয়ান মিটিংঃ
আমাদের সময়কার কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন কস্টা (প্রয়াত) প্রথম গার্ডিয়ান মিটিং-এ এক অভিভাবকের ‘জিপিএ ৫ আরও বাড়ানো’ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ঢাকায় আরও অনেক কলেজ আছে যারা রেজাল্ট নিয়ে কনসার্নড। আমরা রেজাল্ট নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না। জিপিএ কত পেল সেটার থেকে আপনার সন্তান কী শিখতে পারল, এটাই আমাদের কাছে বড়। আপনার যদি এতোই রেজাল্ট নিয়ে সমস্যা থাকে, আপনি টিসি নিয়ে আপনার সন্তানকে সেসব কলেজে ভর্তি করাতে পারেন। আমাদের সমস্যা নাই।
এই কথাটার মর্ম সত্যিকার অর্থে আমি কলেজের বাকি সময়টা অনুধাবন করেছিলাম! আপনি এ কলেজে ভর্তি হলে যাচাই করে দেখবেন, আমি মিথ্যা বলছি কি না!
*** অনেস্টলি ফেলঃ
ফার্স্ট ইয়ারে তখন, ফার্স্ট সেন্ট আপ পরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র। চলাকালীন অধ্যক্ষ বেঞ্জামিন কস্টা স্যার এসে বললেন, তোমরা প্লিজ কেউ অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষা দিও না। তার চেয়ে প্রস্তুতি খারাপ থাকলে ‘অনেস্টলি ফেল’ করে আমার অফিসে এসো, আমি পাশ করানোর ব্যবস্থা করে দিব!
*** কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়াঃ
উদ্ভিদবিজ্ঞানের ল্যাবে একটা পার্টে কৃষ্ণচূরার ডাইসেকশন করার কথা। কিন্তু কলেজে বেশ কয়েকটি বড় বড় রাধাচূড়ার গাছ থাকবার কারণে রাধাচূড়া ফুল সহজপ্রাপ্য ছিল। এসব চিন্তা করে বায়োলিজি ল্যাব সিদ্ধান্ত নেয় রাধাচূড়া দিয়ে ডাইসেক্ট করানোর। বোর্ডের সিলেবাসে কৃষ্ণচূড়া থাকা সত্বেও রাধাচূড়া দিয়ে ল্যাব করানোর জন্য ল্যাব কর্তৃপক্ষকে যে কতবার দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেছি তার হিসাব দিতে পারব না। এই অনুশোচনাপূর্ণ আচরণ চমৎকার বিনয়ের শিক্ষা দেয়, যা সাধারণত কল্পনাও করা যায় না। বায়োলজি ল্যাবের আরেকটা ঘটনা বলি।
*** তেলাপোকার জন্য আত্মত্যাগঃ
যদি ভুল না বলে থাকি তাহলে ডেমোন্সট্রেটর স্যারের নাম ছিল ‘নির্মল অ্যাসেনসেন’। এই লোকের মতো নিবেদিত লোক খুব কম দেখেছি আমি। তেলাপোকার ডাইসেকশন হবে ল্যাবে। দেখা গেল নির্মল অ্যাসেনসেন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ভঙ্গিতে তেলাপোকা বিতরণ করছেন। পাশ থেকে এক স্যার বললেন, এই লোক ফজরের সময় থেকে গাবতলী গিয়ে অপেক্ষা করছিল। এই তেলাপোকাগুলো উত্তরবঙ্গের কোন জেলা থেকে পাঠানো। সেগুলো তিনি নিজেই ভোররাতে গিয়ে এনেছেন ছাত্রদের জন্য! ভাবা যায়!?
*** গাইডেন্স ও জরিমানাঃ
নটরডেম কলেজের কোন দেওয়াল, বেঞ্চ, টেবিল বা চেয়ারে কলম-পেন্সিল বা অন্য কোন কিছুর দাগ পাওয়া যাবে না! অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। স্কুলের টয়লেটে অমুক প্লাস তমুক লেখে আসা ছেলেগুলো ‘গাইডেন্স’ নামক একটি বিশেষ ডিপার্টমেন্টের কারণে অত্যন্ত ‘ভদ্র’ হয়ে যায়! তো একবার গাইডেন্স ঝটিকা অভিযানে আমার হাইবেঞ্চে কলমের একটা আধা ইঞ্ছি বক্ররেখা পেল (আমি দেইনি, কসম)! সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ টাকার একটা জরিমানা রশিদ ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো, সময় করে একাউন্টস সেকশনে গিয়ে জমা করে দিতে। একদম আম্রিকান স্টাইল! সেই রশিদখানা আমার কাছে এখনও আছে!
*** ফিজিক্স ল্যাবে মেকআপঃ
ফিজিক্স ল্যাবে দুইজন ডেমোন্সট্রেটর ছিলেন। ফিলিপ রোজারিও স্যার আর দবিন স্নাল স্যার। এই দুজন সহজে কাউকে ফিজিক্স ল্যাবে পার পেতে দিতেন না। মেকআপ নামে অদ্ভুত বিভীষিকা একবার হলেও পার করতে হয়েছে বিজ্ঞান বিভাগের সবাইকে। একবার, প্রিজমের ল্যাবে, আমি অসামান্য ঐকান্তিকতার সাথে ল্যাব করে দেখানোর পরে স্যার বললেন, কী করসো এইটা। এবসার্ড। যাও মেকআপ। এটা বলে M. Up লিখে দিলেন খাতায়! এই দুঃখে সেদিনই ইত্তেফাক মোরে গিয়ে প্রিজম কিনে এনে একাধিকবার প্রাকটিস করে, পরের ল্যাবে পার পেয়েছিলাম। এই হলো এ কলেজের ফিজিক্স ল্যাবের আখ্যান!
*** কলেজ ক্যান্টিনঃ
কলেজ চলাকালে মাত্র পনেরো মিনিটের একটা রিসেস (অবকাশ) ছিল। আমার সবথেকে পছন্দের ছিল এই পনেরোটা মিনিট। ক্যান্টিনে গিয়ে একটা হটডগ ১৪ টাকা, এককাপ চা ৫ টাকা। মোট ১৯ টাকায় পেট-মন শান্তি করে খাওয়া। এই কলেজের চা আমার খাওয়া দুনিয়ার সবথেকে উত্তপ্ত আর সুস্বাদু চা। শুধুমাত্র এই চা কেউ খেয়ে থাকলে কলেজটাকে মনে রাখতে বাধ্য!
*** জহরলাল স্যারঃ
নটরডেম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হলে জহরলাল স্যারের কথা বলতেই হবে। সর্বদা সাদা শার্ট পরিহিত এই ভদ্রলোকের মাঝে কী যেন লুকিয়ে থাকতো সবসময়। সব থেকে বেশি ভয় পেতাম এই মানুষটাকে, আবার সবথেকে বেশি ভালো লাগতো একই ব্যক্তিকে। স্যারের ক্লাসে একেকটা উক্তি ছিল একেকটা ঐতিহাসিক স্টেটমেন্ট! কয়েকটা বলা যেতে পারে, “কিরে বাপ আছিস কেমন?”, “তোরা গোল্ডেন পায়া আসিস, গোল্ডেন পায়া যাস, মাঝখানে সব ফাঁকা!”, “তোদের তো ওই স্যার ভালো লাগে, যে তিনডা অঙ্ক লাগায় দিলে ছয়ডা আসে।”, “তোরা জানিস না সেটা অপরাধ না, জানতে চাস না সেটা হলো অপরাধ।”, “এখন আরাম করিস না রে বাপ, আজীবন কষ্ট করতে হবে!”, “প্রশ্ন করলে উত্তর পাবি, প্রশ্ন কর”, “যেই মেয়ে এখন তোর মায়ের থেকে বেশি ভালোবাসা দেখাচ্ছে, বিশ্বাস কর, সে একটা ডাইনি!”। আরও অনেক উক্তি আছে স্যারের লিখে শেষ করা যাবে না হয়তো। এই মানুষটার সান্নিধ্য পাবার জন্য হলেও আপনার নটরডেমে পড়ে দেখা উচিত দুই-একবার!
*** সুশান্ত স্যারের দুটি গল্পঃ
পদার্থ বিজ্ঞানের অসাধারণ সব ক্লাস নিতেন সুশান্ত স্যার। উনার নিজের লেখা ফিজিক্স বইটা একটা মাস্টারপিস ছিল। বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার জন্য; এতো এতো অংক উদাহরণসহ দেওয়া ছিল যে, প্রচুর সাহায্য পাওয়া যেত পড়ার সময়। আলাদা শিক্ষক লাগতো না। কিন্তু, ক্লাসে এসে তিনি কোনদিন তাঁর বইটা চাইতেন না। বরং বলতেন, ‘তপন স্যার বা ইসহাক স্যারের বইটাই দিতে পারো। খুব ভালো বই এগুলো।’ কী অমায়িক আচরণ! আমি বই লেখেন এমন কোন সম্মানিত স্যারকে অসম্মান করছি না। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক কিন্তু নিজের বইয়ের ঢোল পেটাতেন এমন জায়গায়। আর অন্য কারোর লেখা বই সহ্য করতে পারতেন না। সুশান্ত স্যারকে এমনটা করতে আমি কোনদিনই দেখিনি।
দ্বিতীয় ঘটনা এরকম, ফিজিক্স কুইজ হয়েছে ১০০ মার্কের। সুশান্ত স্যার ১০ জনকে ইচ্ছে করে প্রাপ্ত নম্বরের চেয়ে ১০ নম্বর বেশি যোগ করে দিয়েছেন। এবং খাতা দিয়ে স্যার অপেক্ষা করছিলেন, এই ১০ জনের মধ্যে কে কে ফিরে এসে জানায় যে নম্বর বেশি দেওয়া হয়েছে। দেখা গেল বেশ কয়েকজন গিয়ে স্যারকে জানাল ব্যাপারটা। স্যার পরে খুলে বললেন পুরোটা। এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু যারা নম্বর বেশি পেয়েও ফিরে এসে দেখায়নি, স্যার তাদের নামও বলে দিয়ে তাদেরকে অপদস্ত করেননি। তবে আমি নিশ্চিত, সবার সাথে সাথে তারাও সেদিন কমপক্ষে নৈতিকতার শিক্ষাটুকু পেয়েছে!
*** ফাদার হেমন্তের চিঠিঃ
এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া সিএমসি ভেলোরে যাবেন কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের কাজে। আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন কলেজের কোন ফাদারের কাছে রিকমেন্ডেশন লেটার নিয়ে দেই, যাতে সময় (অর্থ কোন সমস্যা না) সাশ্রয় হয়। আমি তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল ফাদার হেমন্তের অফিসে গিয়ে কাঁচুমাচু করে বলতেই তিনি বললেন তোমার আইডি কার্ডটা দাও। আমি কার্ডটা দিলাম। স্যার আমার রোল উল্লেখ করে বলে দিলেন, বাংলাদেশ থেকে উনারা যাচ্ছেন, যেন সময় আর অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয় এ ব্যাপারে যেন তাঁরা বিবেচনা করেন। ফাদার হেমন্ত একটা ইমেইল লিখে পাঠালেন সিএমসি কর্তৃপক্ষকে তৎক্ষণাৎ। আর আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চিঠির খামে ঠিকানাটা ফাদার নিজে প্রিন্ট করে কাঁচি দিয়ে কেটে, আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমি হা করে দেখছিলাম। সাহায্য করার জন্য অনুমতি চাইলে তিনি বলেন, এই কাজটুকু তো আমিও করতে পারি সান! এই বলে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আর কি কিছু করতে পারি তোমার আত্মীয়ার জন্য?
আমি নির্বাক ছিলাম কিছুক্ষণ। পরে সে চিঠি আর ইমেইল জাদুর মতো কাজ করেছে এ তো বলার অপেক্ষা রাখে না! ফাদার হেমন্ত এখন নটরডেম কলেজের প্রিন্সিপাল।
*** অনারেবল মেনশনঃ
আর যে কয়েকজন মানুষ সম্পর্কে জানবার জন্য আপনার এ কলেজে আসা উচিত বলে আমি মনে করিঃ
প্রয়াত মুখতার আহমেদ স্যার (স্যার কে নিয়ে আরেকদিন আলাদা করে লিখব!)
মিজান স্যার (বায়োলজি)
গুহ স্যার (কেমিস্ট্রি)
বিদ্যুৎ স্যার (গণিত)
স্ট্যানলি স্যার (গণিত, স্যার সম্ভবত চলে গেছেন এমআইএসটিতে)
রেজা স্যার (গণিত)
মার্লিন ক্লারা পিনেরো ম্যাম (বাংলা)
রিটা জোসেফিন রোজারিও ম্যাম (ইংরেজি)
অমল কৃষ্ণ বণিক স্যার (বায়োলজি)
অ্যাডলিন ম্যাম (বায়োলিজি)
আরও অনেকে…
আরও বেশ কিছু মানুষ ছিলেন। যারা আমার এইচএসসির সময়টাকে আলোকিত করে তুলেছিলেন। আমি জানি না এ কলেজ থেকে আমি কতটুকু নিতে পেরেছি, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার জীবনে একটা বৃহৎ পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি কলেজ পেরুনোর পর।
নটরডেম কলেজ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনাকে বরণ করবার জন্য।
vai,amar ei jibon e eto valo blog ar porsi bole mone hoy na.onek tnx.chaliye jan