আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণঃ পর্ব ১
অন্য সবার মতো এই অধমেরও একবার ‘বিদেশ’ যাবার সুযোগ হয়েছিল। ‘বিলাত’ শব্দটির অর্থ ইংল্যান্ড/ ইউরোপ হলেও আমি দিন কয়েক থেকে, যেই দেশে গিয়েছিলাম সেখান থেকে ফিরে এলে, সম্মানিত খালেদ স্যার ‘বিলাত ফেরতদের’ তালিকায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। আমি খুব বেশিদূরের কোন দেশে যাইনি। গিয়েছিলাম মালয়েশিয়া। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া তেরটি রাজ্য এবং তিনটি ঐক্যবদ্ধ প্রদেশ নিয়ে গঠিত। দেশটি এশিয়ার খাদ্য স্বর্গ হিসেবে পরিচিত। নানা বর্ণ, ধর্ম আর সংস্কৃতির মানুষের অবস্থানের ফলে এখানকার খাবারও বেশ বৈচিত্র্যময়। এসব পরে বলব। আগে বলি গেলাম কীভাবে।
২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর। ক্লাস শেষ করে (বা না করেই হয়তো) নীলক্ষেতের দিকে যাচ্ছি। ভর দুপুর। তখন ভিসি চত্বর এলাকা পার হচ্ছি। বন্ধু মিশু ফোন করল। এই ছেলে UCL-এ এমএস করতে গিয়েছে গত বছর। যারা জানেন না UCL কী জিনিস, অনুগ্রহ করে গুগল করুন। তো মিশু ফোন দিয়ে বলল, “তোরে জোয়ার্দার স্যার খুঁজতাসেন। একটু তাত্তারি আয় আইআইটিতে।” কথাটা শুনে হিম হয়ে গেলাম একটু। বুকের পানি শুকিয়ে গেল। জোয়ার্দার স্যার আমাকে খুঁজছেন! আমি কী এমন বড় অপরাধ করে ফেললাম! যারা স্যারকে চেনেন, তারা বুঝবেন আমার উদ্বেগের কারণ।
স্যারের রুমের সামনে গিয়ে নক করলাম। স্যার ঢুকতে দিয়ে বললেন, “আপনিই আজিমুল? আপনি কি জানেন আমি এমন একজনকে খুঁজছি যে নাকি খুব দুষ্টামি করে বেড়ায়, লেখালেখি করে, ছবি তুলতে পছন্দ করে, আর একটু-আধটু বন্ধু বানাতে পারে।” ‘দুষ্টামি’ বলতে স্যার কী বুঝালেন না বুঝলেও মনে মনে বললাম, “স্যার পার্ফেক্ট ম্যাচ! আপনি যাকে খুঁজছেন – আমিই সেই।” কিন্তু মুখে অসহায় নিষ্পাপ চেহারা বজায় রেখে না বোঝার ভান করলাম। স্যার বললেন, “কয়েকজন ফ্যাকাল্টি আপনার নাম সাজেস্ট করসে। তো বলেনতো ইয়াং বেঙ্গল কারা ছিলেন?” আমি বললাম কারা ছিলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডবদের চিনি কি না। জানালাম তাঁদের ব্যাপারে। তবে বুঝতে পারছিলাম না স্যার কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন। পরে বললেন, “কোথাও যদি পাঠানো হয়, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারব কী না?” না বুঝলেও গতানুগতিক বাঙালি ছাত্রদের মতো করে বললাম, “অবশ্যই পারব স্যার। কোন সমস্যা নাই।” বলেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। স্যার বললেন, “Trans-Eurasia Information Network (TEIN) Youth E-Culture Exchange (Youth ECX)” নামক একটা কনফারেন্সে আমাকে মালয়েশিয়া পাঠানো হতে পারে; তবে ইউজিসির (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) এর কেউ একজন আমার ইন্টারভিউ নিবেন।
বাসায় এসে দেখি স্যার একটি ইমেইল পাঠিয়েছেন। যার সাবজেক্টটা হুবুহু তুলে দিচ্ছি “Please read the email and meet with me tomorrow for effective discussion about the said matter”। পাঠক ভাবুন তাহলে, তারপর দিন কী ‘ডিসকাশন’-টা হলো! যাই হোক, অক্টোবর ২৫ তারিখ সন্ধায় একটা ইমেইল পেলাম ইউজিসির একজন সদস্যের কাছে। মজার বিষয় হচ্ছে ভদ্রলোকের নামের সামনে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ আর পেছনে ‘এমবিএ’ লাগানো! তো সেই এমবিএধারী ইঞ্জিনিয়ার মহাশয় ফোন করে আরেকদফা প্রশ্ন করলেন। আমাকে ইমেইলে নিশ্চিত করা হলো যে, বিশ্বের ৭২-টি দেশ থেকে এই প্রোগ্রামে অংশ নিবে, বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আপনাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
ইমেইল দেখে মাথায় হাত আমার। কনফারেন্সটি নভেম্বরের ১৯-২২ তারিখ। আমার অগ্রজকে ফোন করে জানতে চাইলাম পাসপোর্টই ছাড়া বিদেশ যাওয়া যায় কী না! সে জানাল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনুরূপ বেকুব সে আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। পরদিন দৌড়ে গেলাম জোয়ার্দার স্যারের কাছে। জানালাম, আমার তো পাসপোর্ট নামক বস্তুখানা নাই। স্যার জানতে চাইলেন, তা না থাকুক, সামরিক বাহিনীতে পরিচিত কেউ আছে কি না, থাকলে সাহায্য করতে পারবেন এ ব্যাপারে। অনেকক্ষণ ধরে মনে করার চেষ্টা করলাম, ইহজগতে আমার পরিচিতকূলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কেউ আছেন কি না। একজন পাওয়া গেল। স্যারকে জানালাম, একজন ‘কিঞ্চিৎ’ পরিচিত আছেন। তিনি সাহায্য আদৌ করবেন কী না সন্দেহ আছে। স্যার বললেন, “সাহায্য না পেলে আমাকে জানাবেন, আমি দেখব।” যাই হোক সেই ‘সামান্য’ পরিচিত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে জানালাম। তিনি পাসপোর্ট অফিসের এক লেঃ কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। হাজার হোক নিজের মায়ের পেটের ছোট ভাই কি না!
পরদিন গেলাম পাসপোর্ট অফিস। আগে থেকে অনলাইনে আবেদন করে কপিটি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই লেঃ কর্নেল সাহেব বাকি কাজ পানির মতো সোজা করে দিলেন। কাগজগুলো তুলে দিয়ে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। এসবি অফিসের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিরাট একটা গল্প লেখা যাবে। সে পরে হবে। সেখানে এসপি আশিক ভাই কাজটা এগিয়ে দিলেন আরেক দফা। পরদিন সকালে এসবির রিপোর্ট আর পাসপোর্টের কাগজ জমা দিয়ে এলাম। বিকাল বেলা ফোনে ক্ষুদেবার্তা পেলাম, “Your passport is under the printing Stage.” অর্থাৎ, সাকুল্যে দুইদিনে হলো পাসপোর্টখানা! জয় হোক সেনাবাহিনীর!
এতো গেল পাসপোর্ট পর্ব। বিদেশ যেতে ভিসাও যে লাগে তা জানতাম। কিন্তু ভিসা দেখতে কেমন, সাকার নাকি নিরাকার, সাকার হলে খেতে ‘টেস’ কেমন, নিরাকার হলে পঞ্চইন্দ্রিয়ের কী দিয়ে অনুভব করতে হয়, এসবের কিছুই জানি না তখনও। তবে জানলাম, যেহেতু মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য কনফারেন্সের আমন্ত্রণপত্র আমার কাছে আছে, তাই কয়েক কর্মদিবসের মাঝেই তা পাওয়া সম্ভব। এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করেও কোন সুরাহা করতে না পেরে দ্বারস্থ হলাম আমার সকল সমস্যা সমাধানের প্রধানতম আশ্রয়স্থল, আমার মেজো মামার কাছে। তিনি একটি পরিচিত ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা করে দিবার ব্যবস্থা করলেন। আমাকে একবার যেতে হলো মালয়েশিয়ান হাইকমিশনে। সেখানে গিয়ে যারপরনাই খারাপ ব্যবহার পেয়ে ফিরে এলাম। হাবভাব দেখে বুঝলাম, ভিসা এরা দিবে না!
১৮ তারিখ রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকেট করা ছিল। ১৭ তারিখ ব্যাচের র্যাগডে ছিল। ধরেই নিলাম ভিসা পাবো না। যখন পাবোই না, র্যাগের আনন্দটা মাটি করার কী দরকার! র্যাগডে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করা হলো। মুখ-চোখ-শরীর রঙে ভরা। কিছু কিছু রঙ উঠতে সময় লাগবে সপ্তাহ খানেক! সেদিন বিকালের দিকে জানলাম, তারা ভিসা দিয়েছে। আমি যেতে পারি।
১৮ তারিখ বিহানে (সকালকে আমাদের এলাকায় বলে বিহান) উঠে দেখি আব্বু-আম্মু-ভাইয়া ঢাকায় উপস্থিত। তখন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে থাকতাম। রাতে আমাকে তাঁরা দিয়ে এলেন এয়ারপোর্টে। যদিও এয়ারপোর্টে প্রবেশের বিষয়টা সুখকর ছিল না। ভেতরে ঢুকে যেখানে বোর্ডিং পাস নিতে হয়, সেখানে গিয়ে দেখি আমার সামরিক কর্মকর্তা ভাই ঢুকে গেছে তার ‘হ্যাডম’-এর জোরে। আমাকে বিদায় দেওয়ার পর একা একা লাগছিল। মাত্র ক’দিনের জন্য যাচ্ছি, কিন্তু মনে হচ্ছে আর আসব না। ক্লাস সিক্স থেকে আমি বাড়ি-ছাড়া। হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করা মানুষ। সেই আমি নিমেষেই ‘হোমসিক’ হয়ে গেলাম! যাই হোক, বোর্ডিং পাস পাবার পর কিছু জায়গায় বিরম্বনায় পড়তে হয়েছিল। ইকোনমি ক্লাসের টিকেট কাটবার জন্য বোধহয়। যেমন, এক জায়গায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা আমার সঙ্গে থাকা ডলারগুলো নিয়ে নিলেন। গুণে বললেন, যে পরিমাণ এনডোর্স করা তার মধ্যেই আছে তো? এটা যে তিনি অন্যায় করছেন, আমি তখন বুঝিনি। এই কাজ তো তার করার কথা না। এটা কাস্টমসের লোক করলে আলাদা কথা ছিল। তার উদ্দেশ্য কী ছিল, পাঠক বুঝতেই পারছেন। এরকম বেশ কিছু জায়গায় আচরণে ঔদ্ধত্য পেয়ে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
মন খারাপের জায়গায় আরেকটু নুনের ছিটা দিল প্লেনের আসন বিন্যাস। একে তো জীবনে বিমানে উঠিনি, তারপরে আবার আগে গেলে আগে পাবেন ভিত্তিতে যে আসন বরাদ্দ হয়ে গেছে, তা বুঝতেই পারিনি। শুনুন তাহলে। বিমান এর বোয়িং ৭৫৭-এর ইকোনমিক আসন তিন কলামে বিন্যস্ত। প্রতি কলামে আবার তিনটি করে আসন। তাহলে এক লাইনে আসন নয়টি! এবার আমি যে আসন পেলাম, সেটা বুঝাই। আমার ডানে চারটি, বামে চারটি আসন, মধ্যে আমি। বোঝা গেল? আপনারা ‘বৈদেশে’ যান, বিমানের জানালা থেকে ছবি তুলেন। আর আমি বিমানের একদম পিঠ বরাবর বসে আল্লাহ্ তালার নাম জপি!
তবে বিমানের খাবার-দাবার ভালো ছিল, এ কথা অস্বীকার করতে পারব না। প্রথমে হালকা ও পরে ভারি, দু’ধরনের খাবার খেয়ে তৃপ্তি নিয়ে ঘুমও দিলাম ঘন্টাখানেক। বিমানবালারাও ছিলেন দেখতে যথেষ্ট সুন্দর। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর যেতে প্রায় চার ঘন্টার মতো লাগে। আমার লাগলো উনিশ মিনিট বেশি। পৌছানোর পর কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের (KLIA) ইমিগ্রেশন পার্টটুকুও সুখকর ছিল না। মূলত ঢাকা এয়ারপোর্টের আর কুয়ালালামপুর ইমিগ্রেশনের বাজে অভিজ্ঞতাটার জন্য অনেকদিন এ নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা করেনি। তবে পরে দেখলাম, আমার মতো খয়রাতিদের সাথে এমনই হয়। তাই খামোখা দুঃখ পাবার কিছু নাই; একটু হালকা লাগছে বিধায় লিখছি। তো যাই হোক, ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে এয়ারপোর্টের ওয়েটিং এরিয়াগুলোতে ব্যাগেজ রেখে ওয়াশরুমে গেলাম হাতেমুখে পানি দিবার জন্য। ওয়াশরুমের এক কোণায় দেখলাম জেনিটর ভদ্রলোক পরিষ্কার করছেন। এক সময় আমাকে উদ্দেশ্য করে স্বদেশী টোনে বললেন, “দেশি ভাই নাকি? সিম কার্ড লাগবো? ২০ রিঙ্গিত মাত্র।” বুঝলাম, আমার দেশের ভাইটি একই সাথে দুইটি পেশা চালাচ্ছেন এখানে!
তার কাছে আর সিম নেওয়া হয়নি। এয়ারপোর্টে বাহিরের লাউঞ্জে এসে দেখি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ভোর হতে চলেছে। এখান থেকে আমাকে যেতে হবে ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়ায় (UPM)। আমাকে বলা হয়েছে ‘KLIA Transit’-ধরে চলে যেতে। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম বিধায় এই ‘KLIA Transit’ খায় না মাথায় দেয় বুঝতে পারছিলাম না। সেখানে এক মালয়েশিয়ান ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল, এটা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি রেল সার্ভিস। খুঁজে বের করলাম কোত্থেকে ছাড়ে। টিকেট কেটে উঠে পড়লাম। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টার যাত্রার পুরোটা স্বপ্নের মতো লেগেছে। বিমানে জানালার-পাশে-বসতে-না-পারা কষ্ট ভুলিয়ে দিল এই ট্রেনযাত্রা। অনেক লিখে ফেলেছি এক কিস্তিতে। বাকিটুকু পরে লিখব।