সাদাসিধে কথা
রাত সোয়া আটটা। আমার বাবা ফোন দিয়েছেন। তিনি একজন ব্যস্ত মানুষ হওয়ায় এমনিতেই তাঁর কাছে এমন সময় ফোন আশা করিনি। তবে হুটহাটই নানান তথ্য জানবার জন্য ফোন দেন। ফোন দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেন। চাকরি বা পড়ার খোঁজ নেন। তারপর তাঁর দরকারি তথ্যটা অনুসন্ধান করেন। কিন্তু আজ কুশল বিনিময়ের ধার দিয়েও গেলেন না। প্রথম যে প্রশ্নটা করলেন সেটা হল, “ব্যাটা জাফর ইকবাল সাহেবকে কে অ্যাটাকটা করতে পারে বলোতো।” এ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো। ফোনটা উদ্বিগ্নের মতো রেখে দিলেন। মনে হলোযেন খুব আপন কোন লোকের উপরে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে!
আসলেই তো। জাফর ইকবাল স্যার তো আমাদের আপনজনই। তাই না? এই লেখার শিরোনামটাও কিন্তু তাঁর লেখার শিরোনাম থেকে ধার করা। লোকটার সাথে এইতো সেদিন ঠাকুরগাঁও জিলা স্কুলের হোস্টেলে বসে বসে ‘অবনীল’ বইটির মাধ্যমে পরিচয়। বইটা দিয়েছিল পাশের রুমের ছোটন। তারপর আর থামতে হয়নি। একের পর এক সায়েন্স ফিকশন আর কিশোর উপন্যাস পড়তে লাগলাম। ক্লাস নাইনে পড়বার সময় শ্রদ্ধেয় স্বপন স্যারের মাধ্যমে জাফর ইকবাল স্যারের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটা যোগাযোগ করে ফেললাম। আমার ফোন ছিল না। আরেফিন এর ফোন থেকে এতো এতো ফোন দেই, লোকটা ফোন ধরে না। মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো। ছোট মানুষ ছিলাম। বুঝতাম না একজন এতোবড় মানুষকে এভাবে বিরক্ত করতে নেই। হাল ছাড়িনি। প্রায় প্রতিদিনই ফোন দিতাম। কি সৌভাগ্য! একদিন সত্যি সত্যি তিনি ফোনটা ধরলেন! সালটা মনে নেই। ২০০৮ বা ‘০৯। তারিখটা মনে আছে। ২২ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ এরকমই কোন এক ফাল্গুনের বিকালে তিনি ফোন রিসিভ করলেন। আমিতো বিশ্বাসই করতে পারছি না। বললাম, “এটা কি জাফর ইকবার স্যারের নাম্বার?” ওপাশ থেকে একটা মিহি কিন্তু দ্রুত বাচনভঙ্গির কণ্ঠ জানালো সঠিক নাম্বারে ফোন করা হয়েছে! আমি কি বলব ভেবেই পাচ্ছিলাম না। পাশে আরেফিন ছিল। সেও কথা বলতে নারাজ। টুকটাক ‘কি করছেন’, ‘চা খাচ্ছি’ ধরণের কথা বলেই ফোনটা রেখে দিলাম। আর তখনই মনে হল, হুট করে বড় হয়ে গেলাম। আর কোনদিন স্যারকে ফোন দেইনি। তবে ক্ষুদেবার্তা দিতাম।
স্কুল জীবন শেষ। জাফর ইকবাল স্যারের থেকে তাঁর অগ্রজের বই বেশি টানতে শুরু করল। তবুও বইমেলায় স্যারের এক-দুইটা বই তো কিনতামই। তখন নটরডেম কলেজে পড়ি। মতিঝিল এলাকায় সাবলেট করে থাকি। আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন একবার। রক্তে হিমোগ্লোবিন স্বল্পতার কারণে আমার বাবা রংপুরে নিয়ে গেছেন। সাথে আর কেউ নেই। ভাইয়া ক্যাডেট কলেজে। তাকে কিছু জানাবার সুযোগ নেই। রাতে আমাকে শুধুমাত্র জানানো হল, তাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে এবং কোন দুশ্চিন্তা যেন না করি। সেদিন রাতে আর পড়তে পারিনি। ভীষণ মন খারাপ করে বসে আছি। রাত দুইটা আড়াইটা হয়তো বাজে। কি মনে করে স্যারকে আমার মায়ের অসুস্থতার জন্য মন খারাপের কথা জানিয়ে একটা বার্তা পাঠালাম। ফোনটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন টেরই পাইনি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আমার ক্ষুদেবার্তার উত্তর পাঠিয়েছেন, “I am praying for her quick recovery.” সেদিন আমার কেমন লেগেছিল তা শুধু আমি আর উপরে বসে যিনি নিরবে সবকিছু দেখছেন, তিনিই জানেন!
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। আসলে ডিসেম্বর মাসও শেষ। আমরা ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে ২০১৪ এর জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ল্যাব এইডে ছিলাম আমার মায়ের একটা অস্ত্রোপচারজনিত কারণে। কাকতালীয়ভাবে স্যারের মাও সে সময়ে ল্যাব এইডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দুদিন স্যারের সাথে দেখা করেছিলাম এবং তাঁর মায়ের খোঁজ নিয়েছিলাম। স্যারও খোঁজ নিয়েছিলেন আমাদের।
এরপরে আর স্যারের সাথে দেখা হয়নি। দুর্ভাগ্য হল বইমেলায় কোনদিন স্যারের দেখা পাইনি। এই লোকটাকে (এবং ম্যাডামকে) অনেক আগে থেকেই ধর্মান্ধ কিছু মানুষ হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। আজ দেখলাম তাঁর পরিণাম!
কেন? আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমনটা হবে এঁদের সাথে? বিদেশে দীর্ঘ সময় গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে থাকবার পরে কি দরকার ছিল তাঁদের দেশে ফিরবার? মাথায় চার জায়গায় আঘাতের পাশাপাশি বাঁ হাত ও পিঠে ধারালো ছুরি দিয়ে জখম হবার জন্য? অথবা রেজাউল করিম স্যারের মত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাবার জন্য? আচ্ছা ভালো কথা, নিশ্চয়ই আমরা এতোদিনে রেজাউল স্যারের কথা ভুলে গেছি। তাই না?
অধ্যাপক এ.এফ.এম. রেজাউল করিম সিদ্দিকী। দিনটা ছিল শনিবার। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখ। সময় সকাল ৭ টা ৪০ মিনিট। বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) যাবার পথে নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে রাজশাহী শহরের শালবাগান বটতলা এলাকায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক এসময় হঠাত অধ্যাপক করিম সিদ্দিকীকে আততায়ীরা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ভালো একটা মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে গেল। এরপর রাস্তার মধ্যে খুন হলো। কি দারুণ না? আরও নাম শুনতে চান? এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম খুন হন এ ঘটনার দুবছর আগে। তারও বেশ আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুজন শিক্ষক অধ্যাপক এম ইউনুস এবং অধ্যাপক এস তাহের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মুক্তমনা লেখক-ব্লগার-কলামিস্টদের কুপিয়ে নিশ্চিত হত্যা বা হত্যা চেষ্টার ঘটনাগুলোতো জানেনই। এগুলোর প্রায় সবগুলোই ছিল ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ। আরও জানতে চাইলে এই পাতাটি একটিবার দেখে আসবেনঃ বাংলাদেশে ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ।
আচ্ছা এগুলো মোটামুটি সাম্প্রতিক খবর। আপনাদের কি মনে আছে হুমায়ুন আজাদের কথা? ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলায় মারাত্মক আহত হন তিনি। এ হত্যা মামলার বিচারকার্যই এখনও শেষ হয়নি! তাহলেতো আমরা ধরে নিতেই পারি, যে দেশে দীর্ঘ চৌদ্দ বছরেও একজন প্রগতিশীল লেখকের হত্যা মামলার বিচার কাজের নিষ্পত্তি হয় না, সে দেশে আরেকজন, আরো একাধিকজন প্রগতিশীল মানুষকে কুপিয়ে হত্যা অথবা হত্যাচেষ্টা করা হবেই!
গত কয়েকদিন আগে মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে একটা সংবাদ প্রতিবেদনে দেখলাম, একদল মাদ্রাসার ছাত্র সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলছে, “…তোমার আকাশ তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি” এগুলো অনর্থক! এগুলো গাইলে নাকি দেশাত্মবোধ চেতনা আসেনা!
এখন জাফর ইকবাল স্যারের উপর হত্যা চেষ্টায় হামলার ঘটনা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? হবেই। আরেকদিন যখন তাঁর নিথর মৃতদেহ অভিজিত রায়ের মতো ফুটপাথে পড়ে থাকবে সেদিনও আমাদের স্বাভাবিকই লাগবে! আর কিচ্ছু লিখতে ইচ্ছে করছে না।
স্যার, আমি একজন নিছক ক্ষুদ্র মানুষ। আপনার উপর বর্বর আক্রমণের “তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার” জানানোর মতোও সাধ্য নেই আমার। আপনাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি আর ভালোবাসি। অনেক বছর আগে আপনার দেওয়া একটি ক্ষুদেবার্তার উত্তরের প্রতিউত্তর দিচ্ছি আজ। আপনার মতো করেই, “I am praying for your quick recovery.”