সহোদর
অনেক বছর আগের কথা। তাই বলে প্রাচীন কালের গল্প না। এই ধরুন ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকের ঘটনা। রাত আটটা কি নয়টা বাজে সবে। ছোট্ট একটা মফস্বল এলাকা। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের যেমন অবস্থা থাকার কথা তেমনই ছিল। সন্ধ্যার পরে টানা দুই ঘন্টার মত বিদ্যুত নেই। একজন মধ্যবিত্ত পিতা তার দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে গল্প করতে বসেছেন। ‘কারেন্ট’ নেই এবং বাড়িতে হাড়িকেনের সংখ্যা মাত্র একটি বলে পড়াশোনা আপাতত বন্ধ তাদের। একজন পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে। আরেকজন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। দুজনে আধাশোয়া হয়ে আছে বিছানায়। হারিকেন জ্বলছে নিভু নিভু। সল্প আলোতে ঘরময় যেন একটা রহস্যময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে সহোদর দুজনকে তাদের পিতা কোন রহস্যগল্প শোনাচ্ছেন না। শোনাচ্ছেন একটা সাধারণ গ্রামের সাদামাটা দুই ভাইয়ের গল্প। তাদের পিতা সেদিন যে গল্পটা দু’ভাইকে শুনিয়েছিলেন সেটা এরকমঃ
একটা ছোট গ্রাম। দুই ভাই বাস করে পাশাপাশি বাড়িতে। দৈবক্রমে এক ভাই ধনী, আরেকজন খানিকটা গরিবই বলা চলে। কার্তিকের শেষ দিক। আমন ধান কাটার উৎসব শুরু হয়ে গেছে গ্রামে গ্রামে। ধরি, ধনী ভাইয়ের নাম আবু ওসমান আর গরীব ভাইয়ের নাম আবু সুফিয়ান। তো ধনী ভাই ওসমানের এবারের ফসলে কিঞ্চিৎ ক্ষতি হয়েছে। মাজরা পোকার আক্রমণে তার এবং আশেপাশের কয়েক একর জমিতে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে সুফিয়ানের ধান বেশ সবল আছে। কোন প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ধান কাটা শেষ দিকে। কিছু ধান মেড়ে বস্তায় ভরে ভরে রাখা হচ্ছে। এর মাঝেই এক রাত্রে আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা দেখা গেল। আসলে দেখা গেল না। এই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইল মহাকাল।
গভীর রাত। প্রায় একটার মত বাজবে। সুফিয়ান তার ধানের গোলা থেকে মেড়ে রাখা ধান কয়েকটা বস্তায় ভরে একটা একটা করে পিঠে নিয়ে চলেছে তার ভাই ওসমানের গোলার দিকে। উদ্দেশ্য, তার ভাইয়ের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভাইয়ের কষ্টে সে পাশে দাঁড়াবে না তো কে দাঁড়াবে? ধানগুলো গোলায় ফেলে খালি বস্তা নিয়ে নিজের বাড়ির উঠোনে আসল সুফিয়ান। রাজ্যের ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। কয়েকটা বস্তা একাই পিঠে করে আরেক জায়গায় পৌঁছানো কম কষ্টের না নিশ্চয়ই। হাতেমুখে কিছু পানি ছিটিয়ে শুয়ে পড়ল সুফিয়ান। আধা মিনিটের মাঝেই যেন ঘুমিয়ে পড়ল সে। শান্তির ঘুম!
সুফিয়ান যখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল ঠিক তখন তার ভাই ওসমান ঘর থেকে বের হল। উদ্দেশ্য, কাছি করে রাখা যে ‘ভালো’ ধানগুলো এখনও মাড়ানো হয়নি সেগুলোর কিছু অংশ ছোটভাই সুফিয়ানের কাছিগুলোতে রেখে আসবেন। ভাইটা তার আর্থিকভাবে একটু দুর্বল। তার পাশে সে ছাড়া আর কে দাঁড়াবে? কাটা বাঁশের মধ্যভাগ কাঁধে নিয়ে দুপ্রান্তে কাছিতে করে যতগুলো নেওয়া যায় ততগুলো ধান নিয়ে সুফিয়ানের বাড়ির বাহিরের উঠোনে ধানের পুঞ্জিতে ফেলে আসল আবু ওসমান। শুধুমাত্র সেবার হেমন্তেই নয়, প্রত্যেক বছরের আমন ধান কাটার পড়ে এই ঘটনার অনুবৃত্তি ঘটত। ‘উপরে’ বসে যিনি সব কিছুর কলকাঠি নাড়ছেন, তিনি এসব দেখতেন আর মৃদু হাসতেন।
গল্প শেষ। সাদামাটা গল্প। গল্পে দুর্বলতাও আছে অনেক। তবে এই গল্পটার গুরুত্ব কতটুকু তা গল্পকথক পিতার চেয়ে বেশি কেউ আর জানত না।
এ ঘটনার প্রায় বিশ বছর পরের ঘটনা। ইন্সটাগ্রাম আর ফেইসবুকের সময়। যে সহোদরেরা গল্প শুনছিল তারা এখন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। তাদের দুজনের কারও এই গল্প মনেও থাকবার কথা না! মনে নেইও। সহোদর দুজন ভালই আছে। তবে তাদের মধ্যে আর্থিক অবস্থাটা সামান্য ওসমান আর সুফিয়ানের মতই। এবারও ধরে নেই, ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে একজন ওসমান, আরেকজন সুফিয়ান। তো ওসমান সুফিয়ানকে মেসেঞ্জারে কড়া নেড়েছে,
: কিরে? কি করিস? টাকা ‘প্যায়সা’ আছে? অর ইউক ক্যান লেন্ড ফ্রম মি। 😛 😛
: লেন্ড লাগবে না থাক। চলে যাচ্ছে তো দিন। আছি ভালই।
: লাগবে লেন্ড। লাগবে। তবে উচ্চহার সুদে। 😛 ৪-৫ বছর পর দিলেও হবে। চক্রবৃদ্ধি হারে।
: এমনিতেই তোর কাছে আমার অনেক দেনা। লাগবে না। 😛
: তাহলে একেবাড়ে গাড়িটা কেনার সময়ই দিস। পাঁচ-ছয় বছর পর। 😛 এন্ড ডন্ট টেল ইট টু আম্মু অর আব্বু…
: ওকে। 🙂
তাদের এই কথামালার নাটকীয়তাও ওই ‘উপরে’ বসে যিনি কলকাঠি নাড়ছেন, তিনি দেখছেন আর মৃদু হাসছেন।
এই যে নাটকটা হয়ে গেল, তা কিন্তু ওই যে গল্পের শুরুতে যে মধ্যবিত্ত পিতা গল্প শুনিয়েছিলেন তাঁর কোনদিন জানা হবে না। জানবার দরকারও নেই। তাঁর দায়িত্ব ছিল তো শুধু গল্পটা বলা। এরকম আরও কিছু গল্প বলা। যে গল্পগুলো অনেক সাদামাটা। যে গল্পেগুলোর বৈশিষ্ট্যগত দুর্বলতা আছে অনেক। এই ‘দুর্বলতা সমৃদ্ধ’ ‘সাদামাটা’ গল্পগুলোই কিন্তু বাস্তব জীবনে অনেক বেশি নাটকীয়তার দৃশ্যায়ন ঘটায়। যা গল্পের ‘সাদামাটা’ ‘দুর্বল’ আবেগকেও ছাপিয়ে যায়। পাঠক, তাই নয় কি?