হাতঘড়ি এবং অন্যান্য
আজ রফিকের ভীষণ মন খারাপ।
ওর শখের ঘড়িটা হারিয়ে গেছে বাসায় ফেরার পথে। বাস থেকে নেমেই রফিক বুঝতে পেরেছিল যে ঘড়িটা ‘গেছে’। মোভ্যাডোর খুব দামি একটা ঘড়ি ছিল ওটা। গত জন্মদিনে তার স্ত্রী মিলি তাকে উপহার দিয়েছিল ঘড়িটা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা রফিকের জীবনের প্রথম হাতঘড়ি। কাউকে বললে বিশ্বাসই করতে চায় না কথাটা । মিলি বেচারা জানতে পারলে ব্যাপক মন খারাপ করবে। এটার দামও অনেক। হুবুহু ওইরকমই একটা যে কিনে নিবে তাও এই মুহূর্তে সম্ভব না। মিলিকে অনেক অনুরোধ করার পর ও দাম বলেছিল। সাড়ে দশ হাজার টাকা! রফিকের কাছে এতোগুলো টাকা নেই এখন।
বাসায় এসে কাপড় বদলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল রফিক। মন খারাপ হলেই সে এটা করে, মিলির সেটা জানা আছে। অন্যান্য দিন এসে মিলির সাথে একটু আধটু দুষ্টামি করে সে। রান্না ঘরে গিয়ে দেখে কি রান্না হয়েছে। যেটাই রান্না করা থাকে সেটা দেখেই রফিক বলে, আজ এটাই খেতে ইচ্ছা করছিল! তুমি কীভাবে বুঝলে? মিলি জানে এটা তাকে খুশি করার জন্যই বলা। তারপরেও সে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, আমি জানব না তো কে জানবে? পাশের বাসার রহমান সাহেবের বউ? মিলি জানে ওকে কতটা ভালোবাসে রফিক। তার জন্য রফিক অনেক কষ্ট করেছে। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ওদের প্রেম। ভার্সিটিতে পড়ার সময় রফিক অনেক বলত, তোমার আমার বিয়ে সম্ভব না। তোমার বাসার কেউই আমাকে মেনে নেবে না। আমার না আছে চাল, না আছে চুলো। মিলি বোঝাতো, দেখো, তুমি কষ্ট করে বিসিএসটা দাও ভালমতো। দেখবে কেউ আর না করবে না। রফিক দুইবার বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় টিকলেও অবশেষে টিকতে পারেনি। সে এখন একটা ব্যাংকে চাকরি করে। এটা নিয়ে রফিকের মনে একটা চাপা কষ্ট কাজ করে সবসময়। মিলির সাথেই শেষমেশ বিয়ে হয়েছে তার। মিলি নিজেও একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। আজ সে চিনিগুড়া চালের খিচুড়ি রান্না করেছে। রফিকের খুব পছন্দের খাবার। সাথে শুধু ডিমভাজি লাগবে। আর কিচ্ছু না!
রফিকের মন খারাপ দেখে মিলি রফিকের মাথার কাছে গিয়ে বসল। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার? এসেই শুয়ে পড়লে যে? রফিক লক্ষ্য করল মিলি তার পছন্দের সবুজ শাড়িটা পড়েছে আজ। কত মায়াবতী মেয়েটা! সে বলল, মাথাটা খুব ব্যাথা তাই শুয়ে আছি মিনমিনি। রফিক আদর করে মিলিকে মিনমিনি ডাকে। মিলির অদ্ভুত এই নাম সে কলেজ জীবনে দিয়েছিল। মিলির এই নামটা খুব পছন্দের। রফিক মিলির দিকে পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মিনমিনি, জীবনে কোন জিনিসটা খুব জরুরী বলতে পারো? মিলি বলল, টাকা আর ভালোবাসা। রফিক হেসে বলল, না। সবচেয়ে জরুরী হল বউয়ের কাছে কথা লুকানো। বলেই সে বিছানা কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল।
নিমেষেই মন ভালো হয়ে গেল তার। তার হঠাত সুখী মনে হতে লাগল নিজেকে। এরকম একজন মমতাময়ী স্ত্রী থাকলে কোন কিছুই আসলে হারাবার নয়। মিলিকে সে ঘড়ি হারানোর ঘটনাটা বলল। মিলি হেসে উড়িয়ে দিল, হারাতেই পারে, তাই বলে এভাবে এসে কেউ মন খারাপ করে শুয়ে থাকে? জানো আজ কি রান্না করেছি? রফিক আদুরে গলায় উত্তর দিল, হুম, ঘ্রান পাচ্ছি ম্যাডাম। মোমবাতি আছেতো বাসায়?
ঘরের সব আলো নিভিয়ে দু’জনে মোমের আলোয় খেতে বসল।
একেকটা মধ্যবিত্ত সংসার আসলে একেকটা সুখের কারখানা। কষ্টটা, কান্নাটা, অশ্রুটা আর আবেগটা বেশি বলে আনন্দটাও এখানে অনেক বেশি। ছোট ছোট দুঃখগুলো সেই আনন্দের আতিসাহ্যে কোথায় যেন ভেসে যায়। সেখানে রফিকদের বিশাল বিশাল মাছের খামার থেকে কি করে পাঁচ বছরে একশগুণ আয় করতে হয় তা ভাবতে হয়না। সেখানে রফিকরা বিছানা-বালিশের নিচে কালোটাকা লুকিয়ে রাখে না। সেখানে কীভাবে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে হয় তা ভাবতে বসে না রফিকরা।
যাই হোক। খাওয়া শেষ করে দু’জনে বসে বসে একটা সিনেমা দেখা শুরু করল। মুভিটার নাম ‘অক্টোবর স্কাই’। দুজনের অসম্ভব ভাল লাগল সিনেমাটা দেখে। দেখা শেষ করা মিলি ঘুমিয়ে গেল। রফিক সিনেমাটার একটা ছোটখাট রিভিউ লেখা শুরু করল। এটা রফিকের ছোটবেলার অভ্যাস। রফিক যখন ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দিবে সে সময় তার বাবা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কি করতে চাও জীবনে বাবা রফিক? রফিক বলেছিল, বাবা আমি একজন প্রফেশনাল মুভি রিভিউয়ার হতে চাই! বাবার সেদিনের অগ্নিদৃষ্টি এখনও রফিকের মনে আছে!
লেখাটা শেষ করে রফিক তার শিরোনাম ঠিক করল, ‘হেমন্তের আকাশ’! সে একটা ব্লগেও ইদানিং লেখালেখি শুরু করেছে। ব্লগটার নাম ‘ব্লগ | হিউম্যানস অব ঠাকুরগাঁও’। রফিকের গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও-এ। এই রিজিওনাল ব্লগটাতে রফিক এখন নিয়মিত লেখে। লেখে শেষ করে ব্লগে পোস্ট করল রফিক। শুতে যাবে এমন সময় একটা বিষয় মনে পড়ল তার। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল রফিক।