নিরুর খুব রাগ। খুবই। আজ ওকে বারোটা বাজার ৪০ মিনিট দেরিতে উইশ করেছি দেখে রাতে আর পাশে শুতে দেয়নি! ড্রয়িং রুমে আধাশোয়া হয়ে লিখছি। আমি খুচরা লেখক। হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিকে স্মরণ করে তার লেখাকে শত ভাগ অনুসরণ-অনুকরণ করে বাজারে ৯ টি বই বের করেছি। আসে পাশে যা দেখি এবং দেখি না, তাই নিয়ে লিখে ফেলি। লেখার মান নিয়ে কোন চিন্তা করি না। কারণ, আমরা যখন ভার্সিটি পড়ুয়া ছিলাম তখন পুটুনদা’ নামে একজন মহান লেখক ‘লেখক হবার ২৩১ টি নিয়ম’ বইয়ের ৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, লেখার মান বিবেচ্য নয়। আজকের নিম্নমানের চণ্ডাল লেখা কাল হতে পারে হরিশ্চন্দ্র অথবা শ্মশানের শিবের মত মাননীয়। আজকের এই লেখাই হতে পারে কালকের মহাযোগী সম্রাটের শেষ চিঠির মত মূল্যবান। কাল তোমাকে ‘ওরাই’ অর্ঘ্য দান করবে, করবে নান্দী-পাঠ। আমি সেদিন ভেবে পাইনি কিভাবে একজন অমানুষ কবি কাজী নজরুল ইসলামের মানুষ কবিতাকে ভয়াবহভাবে কপি করে অখাদ্য গদ্যরুপ দান করবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে পারেন। অবশ্য তিনিই আমার মান-অমান-নিম্নমান লেখার পরমানুপ্রেরণা!

যাই হোক, আজ আমাদের ২৭ তম এনিভারসারি। উচ্চারণটা হবে অ্যানিভারসারি। আমার কথা না। নিরুর কথা। আমি উচ্চারণ করলে নাকি ‘ইউনিভার্সিটি’ শোনায়। আমি ওর কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি এবং পালন করি। এবং অনেক ভয় পাই। ও অনেক জানে তো তাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’ পড়েছে। আমি ল’য়ের ল-ও জানি না। ধাপ করে দরজা লাগিয়ে শুবার আগ মুহুর্তে ও বলেছে, কাল তোমার খবর আছে। এই কথার মানে বিভিন্ন হতে পারে। কাল আমার জন্য ভালো খারাপ দুটোর যেকোনটা হতে পারে। যেহেতু কাল দিনের বেলা আমাদের এনিভারসারি মতান্তরে অ্যানিভারসারি, ও কাল ভালোমন্দ কিছু রান্না করতে পারে। এখানে বলে রাখা ভালো, আমি ছাত্রাবস্থাতেই ভালো রান্না করতাম এবং দুবার রান্নার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। এর মধ্যে একবার দ্বিতীয় রানার-আপ হয়েছিলাম ‘এলাচি লবঙ্গ কে হবে আজকের শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি-সিজন ২’ প্রতিযোগিতায়। তাই বাসার অধিকাংশ রান্না আমি আনন্দ নিয়েই করি। নিরু রান্না করলে অবশ্য লবন একটু বেশি হয়। তারপরেও ও যেদিন ভালো কিছু রান্না করে এ বাসা আনন্দ নিকেতন হয়ে যায়। আমাদের বাসার নাম হুমায়ূন সাহেবের দখিনা হাওয়ার অবলম্বনে ‘মাতাল হাওয়া’। বাসার নেমপ্লেট বানিয়ে সানন্দে নিরুকে দেখালাম যেদিন, ও চোখ কপালের দুই আঙুল উপরে তুলে বলল, এ কি করেছো? মাতাল হাওয়া তো হুমায়ূন আহমেদের একটা বইয়েরই নাম! উনাকে কপি ছাড়া চলতে পারো না? আমার মনের মধ্যে জমে থাকা সন্দেহ দূর হল। আমার নামটা পরিচিত মনে হচ্ছিল দিবার সময়!! তো নিরুর ভালো খাবার রান্নার দিন আমার এ নেমপ্লেটটা পাল্টে ফেলে ‘আনন্দ নিকেতন’ নামের একটি ফলক লাগাতে ইচ্ছে করে। রাতে না হয় খুলে মাতাল হাওয়ার ফলকটা লাগিয়ে দিলাম। সাহস পাই না। তাই কাজটা করা হয়নি। তা যাক। তো কাল আমার সাথে খারাপ যে টা হতে পারে সেটা হল কাল নিরু সারাদিন আমাকে খেতে নাও দিতে পারে। যেদিন খাওয়া নিষিদ্ধ, সেদিন আমার জন্য রান্নাঘরে প্রবেশ কবিরা গুনা। বাসাবাড়ি অভ্যন্তরীণ আইন নামক একটা রাফখাতায় নিরু এসব লিখে বাসার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। তাই কাল উপোষ, এটা আমার ‘খবর’ নামক পয়সার আরেক পিঠ হতেই পারে এ ভেবে সোফার একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি এলার্ম বাজছে ফোনে। এলার্ম বন্ধ করেই দেখি ফেইসবুকে নোটিফিকেশন। নিরু স্ট্যাটাস দিয়েছে, আর অভিমান জানাবো না, বাসবো ভালো নিজেকে (নাম না জানা সমগোত্রের ইমোটিকন তিনটি)। তিন একটি বিশেষ সংখ্যা যা জগতের সকল অস্তিত্বের রহস্য ধারণ করে-এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাংবার পর মনে হল, আজকে আমার আকাশে মহাদুর্যোগের ঘনঘন ঘটা! এই স্ট্যাটাস মানে তো মহাপ্রলয় আগন্তুক! আমি চুপচাপ বোমাটি ফাটবার মুহুর্মুহু প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকলাম। হাতে তসবি ছিল না। তসবি থাকলে দেখে মনে হত, আমি জিকির করছি।

কিছুকাল অপেক্ষা করে একটা কাগজে কবিতা লিখতে শুরু করলাম,

                              ওগো নিরুপমা

                              তোমার নেই কোন উপমা

                              তোমার রান্নার মহিমা

                              জানে কি কাজের বেটি রহিমা?

এ পর্যন্ত লিখে থামলাম। আমাদের বাসায় এখন যে ভদ্র-মহিলা কাজে সাহায্য করেন, তার নাম রহিমা না। তবে র দিয়ে নাম। রশুনির মা। আচ্ছা, এর মানে তো তার কন্যার নাম রশুনি। ছেলে থাকলে নিশ্চয়ই তার নাম রশুন। রশুন নিয়ে আমার ছেলেবেলার একটা গল্প আছে। বাসায় এক অতিদূর সম্পর্কের পাকিস্তানি আঙ্কেল এসছিলেন। আমি দরজা খুলে বলেছিলাম, গার্লিক প্লিজ, ফাদার নো হোম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট? বললাম, গার্লিক ইন দ্য চেয়ার প্লিজ। গার্লিক মানে রসুন। আমি যে বইয়ে পড়েছিলাম সেখানে রসুন এর র এর ডট মিশে গিয়েছিল, লেখা ছিল ‘বসুন’! তো যেহেতু আমাদের বুয়ার নাম রশুনি বা রহিমার কোনটাই না, তাই কবিতা লেখার চেষ্টায় বিরতি দিলাম এবং আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম নিরু আর আমি কোথাও ঘুরতে গিয়েছি। নদী আছে এরকম একটা যায়গায়। সাথে করে ও নুডুলস বেধে নিয়েছে। মটর দেওয়া নুডুলস; কি যে মজা! স্বপ্নে দেখলাম, আমরা মটর দেওয়া নুডুলস খাচ্ছি। নিরু খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে নুডুলস তুলে দিচ্ছে। আমি আহ্লাদ করে বললাম, নিরু তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা বেঁধেছি। ও বলল শোনাও, কবিতাটা শোনালাম। নিরুর মুখ শুকিয়ে গেল। আমাকে বলল, রহিমা কে? আমি পাংশু মুখে বললাম, আমার স্বর্গীয় নানাজানের নাম আব্দুর রহিম। রহিমা নামে তো কাউকে চিনি না।

আমাদের পথচলা আমাদের পথে (পর্ব ২)

মন্তব্য করুন